বইগুলো দেখছি।
অন্ধকারে?
আমার কাছে আলো আর অন্ধকার নেই। আমার অবলাল সংবেদী চোখ দিয়ে আমি দৃশ্যমান আলো না থাকলেও দেখতে পারি। আমি অবলাল বা অতিবেগুনি রশ্মি ব্যবহার করতে পারি।
আবদুল্লাহ এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, আপনি এত রাতে কী করছেন?
ঘুম আসছিল না তাই উঠে এসেছি।
ঘুম?
হ্যাঁ।
ঘুম একটি জিনিস যার সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই। কিন্তু আপনার কেন ঘুম আসছে না? আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনার খুব ঘুম পেয়েছে।
তুমি আমাকে দেখতে পাচ্ছ?
হ্যাঁ, আপনাকে আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। আপনি চমৎকার হালকা গোলাপি রঙের একটি নাইটি পরে আছেন।
নাসরীন নিজের অজান্তে নাইটিটা শরীরে ভালো করে টেনে নিতে গিয়ে থেমে গিয়ে বলল, আমি আলো জ্বালাই?
জ্বালান।
অন্ধকারে আমি তোমার মতো দেখতে পাই না, আর কাউকে না দেখলে আমি তার সাথে কথা বলতে পারি না।
নাসরীন এগিয়ে গিয়ে আলো জ্বেলে দিল। দেখা গেল শেলফের সামনে আবদুল্লাহ কয়েকটা বই হাতে নিয়ে উদাসীন মুখে বসে আছে। নাসরীন এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি কী বই দেখছ?
কবিতার বইগুলো। অত্যন্ত চমৎকার সংগ্রহ, আমি দেখে মুগ্ধ হয়েছি।
নাসরীন আরো একটু এগিয়ে এসে আগ্রহ নিয়ে বলল, তুমি কবিতা পড়?
আপনি যদি ধৃষ্টতা হিসেবে না নেন তাহলে বলব হ্যাঁ পড়ি
কার কবিতা তোমার ভালো লাগে
কবিতার প্রকৃত রস আস্বাদন করার ক্ষমতা আমার নেই। মানুষের মস্তিষ্কের তুলনায় আমার কপোট্রন খুব নিম্নস্তরের। আমার কাছে যে কবিতা ভালো লাগে আপনার কাছে তা হয়তো অত্যন্ত ছেলেমানুষি বলে মনে হবে।
তবু শুনি।
এই যে বইটি। অত্যন্ত সহজ স্পষ্ট ছন্দবদ্ধ কবিতা—
নাসরীন তরল গলায় বলল, কী আশ্চর্য, এটা আমারও সবচেয়ে প্রিয় বই।
বইটি হাতে নিয়ে সে আবদুল্লাহর পাশে বসে পড়ে। চকচকে মলাটে হাত বুলিয়ে নরম গলায় বলল, আমি যখন কলেজে পড়ি তখন একজন আমাকে এই বইটি উপহার দিয়েছিল।
আবদুল্লাহ মৃদু স্বরে বলল, কথাটি বলতে গিয়ে আপনার গলার স্বরে একটা ছোট পরিবর্তন হয়েছে। মনে হয় এই বইটির সাথে আপনার কোনো সুখস্মৃতি জড়িয়ে আছে।
নাসরীন কিছু বলার আগেই হঠাৎ জাহিদের তীব্র চিৎকার শোনা গেল। সে কখন নিঃশব্দে উঠে এসেছে তারা লক্ষ করে নি। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে মুখ বিকৃত করে বলল, কী হচ্ছে এখানে? প্রেম? রবোটের সাথে প্রেম? বাহ! বাহ!
নাসরীন কী একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই জাহিদ আরেকটু এগিয়ে এসে ঘরের সোফায় একটা লাথি মেরে বলল, রবোটের সাথে প্রেম? তারপর কার সাথে হবে? জন্তু জানোয়ারের সাথে?
নাসরীনের মুখে রক্ত উঠে এল। সে আবার কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই জাহিদ হঠাৎ প্রায় ছুটে এসে নাসরীনের একটা হাত ধরে তাকে ঝটকা মেরে টেনে তোলার চেষ্টা করে বলল, বেশ্যা মাগী তুই ঘরে বসে আছিস কেন? রাস্তায় যা।
নাসরীনের চোখ জ্বলে ওঠে, সে চাপা গলায় বলল, মুখ সামলে কথা বল।
জাহিদের মুখ প্রচণ্ড আক্রোশে কুৎসিত হয়ে আসে, সে চিৎকার করে বলল, তোর সাথে আমার মুখ সামলে কথা বলতে হবে? বেশ্যা মাগী।
জাহিদ ভয়ঙ্কর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে হঠাৎ হাত তুলে প্রচণ্ড জোরে নাসরীনকে আঘাত করল–অন্তত সে তাই ভাবল। কিন্তু তার হাত নেমে আসার আগেই এক অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতায় আবদুল্লাহ উঠে দাঁড়িয়েছে, নাসরীনকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে সরিয়ে নিয়েছে এবং অন্য হাতে জাহিদের হাতকে ধরে ফেলেছে।
কী হয়েছে ব্যাপারটা বুঝতেই জাহিদের কয়েক মুহূর্ত লেগে যায়। যখন বুঝতে পারল তখন সে আরো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল এবং এক ধরনের অন্ধ আক্রোশে আবদুল্লাহকে আঘাত করার চেষ্টা করল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে অবাক হয়ে আবিষ্কার করল সেটি পুরোপুরি অসম্ভব অর্থহীন একটি প্রক্রিয়া।
আবদুল্লাহ অত্যন্ত শক্ত হাতে জাহিদকে ধরে রেখে নরম গলায় বলল, আপনি অর্থহীন শক্তি ব্যয় করছেন।
জাহিদ উন্মত্তের মতো বলল, চুপ কর শালা। দাঁত ভেঙে ফেলব রবোটের বাচ্চা
আমাদের ভিতরে কোনো রাগ নেই। আবদুল্লাহ জাহিদকে এক হাতে শক্ত করে ধরে রেখে বলল, আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে রাগ না–থাকা ব্যাপারটি একটি আশীর্বাদ। মানুষ রেগে গেলে তাকে খুব কুশ্রী দেখায়।
খামোশ! চুপ কর শুয়োরের বাচ্চা। ছেড়ে দে আমাকে
আপনি একটু শান্তি হলেই আপনাকে আমি ছেড়ে দেব। এখন আপনাকে ছেড়ে দিলে আপনি আমাকে আঘাত করার চেষ্টা করে খারাপভাবে আঘাত পেতে পারেন।
আবদুল্লাহ জাহিদকে প্রায় শূন্যে ঝুলিয়ে রাখল, জাহিদ সেই অবস্থায় তার হাতপা ছুঁড়তে থাকে এবং তাকে অত্যন্ত হাস্যকর দেখায়। নাসরীন আবদুল্লাহর প্রশস্ত বুকে নিজেকে আড়াল করে রেখেছিল এবার সাবধানে মুখ তুলে তাকাল। আবদুল্লাহ নরম গলায় বলল, আপনি নিরাপদ কোনো জায়গায় চলে যান। তাহলে আমি একে ছেড়ে দিতে পারি।
নাসরীন তার মুখে অত্যন্ত বিচিত্র একটা হাসি ফুটিয়ে আবদুল্লাহর বুকে মাথা রেখে বলল, আমি এর থেকে নিরাপদ জায়গা খুঁজে পাব না।
আবদুল্লাহ একটু ইতস্তত করে বলল, আপনি অন্তত একটু নিরাপদ দূরত্বে সরে যান। আমি তাহলে একে ছেড়ে দেবার কথা চিন্তা করব।
নাসরীন বলল, আমি কোথাও যাব না, তুমি বরং ওকে বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দাও।
আবদুল্লাহ হেসে বলল, কোনো মানুষকে এ ধরনের কিছু করার ক্ষমতা আমার নেই। আপনি একটু সাবধানে থাকুন, আমি একে ছেড়ে দিচ্ছি।