যখন যে প্রজেক্টে যাই তখন সেই প্রজেক্টের উপযোগী একটা নাম দেয়া হয়।
আপনার–
জাহিদ আবার হা হা করে খারাপভাবে হাসতে শুরু করে। হাসতে হাসতে বলল, এটা একটা রবোট, এর সাথে আপনি জি–হুজুর করার কোনো দরকার নেই।
নাসরীন রবোটটার দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল, আপনার মানে তোমার কি অনুভূতি আছে?
রবোটটি ঠিক তখন জাহিদের জুতোর ফিতা খুলে এনেছে, সে জাহিদের পা নিচে নামিয়ে রেখে সোজা হয়ে দাঁড়াল, তার মুখে অত্যন্ত সূক্ষ্ম একটা হাসি কিংবা হাসির মতো একটা ভঙ্গি ফুটে উঠল। বলল, অনুভূতি একটা অত্যন্ত মানবিক ব্যাপার। রবোটের অনুভূতি আছে বলে দাবি করা হবে অত্যন্ত বড় ধরনের ধৃষ্টতা। তবে
তবে কী?
মানুষ যে পরিবেশে আনন্দ দুঃখ কষ্ট বা অপমান বোধ করে সপ্তদশ প্রজাতির রবোটের কপোট্রনেও ঠিক সেই পরিবেশে আনন্দ দুঃখ কষ্ট বা অপমান নামের মডিউলে এক ধরনের অসম পটেন্সিয়ালের জন্ম হয়। মানুষের অনুভূতির সাথে তার কোনো তুলনাই হয় না কিন্তু তবু আমাকে স্বীকার করতে হবে আমাদের কপোট্রনে এ ধরনের কিছু একটা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।
জাহিদ শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বলল, সেটা একটা মহা মূর্খামি হয়েছে।
আবদুল্লাহ নামের রবোটটি চুপ করে রইল। নাসরীন বলল, কেন, এটাকে মূর্খামি কেন বলছ?
কারণ মানুষের এই অনুভূতি দরকার। রবোটের কোনো দরকার নেই। রবোটকে যত খুশি অপমান করা যায়, রবোট অপমানিত হয় কিন্তু সে রাগ করতে পারে না। এই অনুভূতির মূল্য কী?
নাসরীন ভুরু কুঁচকে বলল, রবোটের ভিতরে যদি অনুভূতি থাকে তাহলে রাগ নেই কেন? রাগও তো একটা অনুভূতি!
জাহিদ আঙুল দিয়ে কান চুলকাতে চুলকাতে বলল, নিরাপত্তা। নিরাপত্তার জন্যে রবোটের মাঝে কোনো রাগ দেয়া হয় নি। সব রবোট হচ্ছে মাটির মানুষ।
কথা শেষ করে জাহিদ হা হা করে হাসতে থাকে। নাসরীনের ভুলও হতে পারে কিন্তু তার স্পষ্ট মনে হল আবদুল্লাহর চোখে এক ধরনের বেদনার ছাপ ফুটে উঠেছে।
রাতে খাবার টেবিলে আবদুল্লাহ নাসরীন এবং জাহিদকে খাবার পরিবেশন করল। জাহিদ চেয়ারে পা তুলে অত্যন্ত আয়েশ করে খেলেও নাসরীন কেন জানি ভালো করে খেতে। পারল না। একজন অত্যন্ত সুদর্শন মানুষ অভুক্ত অবস্থায় তাদের খাওয়াচ্ছে ব্যাপারটা সে ঠিক গ্রহণ করতে পারল না, যদিও সে খুব ভালো করে জানে সুদর্শন মানুষটি একটি বোট ছাড়া আর কিছু নয়। খাবার টেবিলে বা অন্য কোথাও জাহিদ আজকাল নাসরীনের সাথে বেশি কথা বলে না, আজকেও তার ব্যতিক্রম হল না। সে মিনি ভিডি রিডার নিয়ে দূরপ্রাচ্যের একটি আইস হকি খেলাতে মগ্ন রইল। নাসরীন খানিকক্ষণ খাবার নাড়াচাড়া করতে করতে আবদুল্লাহকে বলল, তোমার খিদে পায় না?
না। আবদুল্লাহ মাথা নাড়ল এবং মানুষের মতো হাসল। বলল, খিদে একটা অত্যন্ত মানবিক অনুভূতি। পৃথিবীর সভ্যতার একটা বড় অংশের জন্ম হয়েছে সুসংবদ্ধভাবে ক্ষুধা নিবৃত্তির প্রচেষ্টার কারণে। সে কারণে মানুষেরা সভ্যতার জন্ম দিতে পারে, রবোটেরা কখনো সভ্যতার জন্ম দেবে না।
তোমরা যেভাবে অনুভূতির জন্ম দিয়েছ সেভাবে তো খিদের অনুভূতিটাও তৈরি করে নিতে পার।
আবদুল্লাহ এক মুহূর্ত দ্বিধা করে বলল, আপনি অত্যন্ত কৌতূহলোদ্দীপক একটা কথা বলেছেন। সত্যি সত্যি সেটা করা হলে কী হবে সেটা জানার জন্যে আমার একটু কৌতূহল হচ্ছে।
কী আর হবে। তোমরাও আমার সাথে বসে খাবে।
ক্ষুধা তৃষ্ণা থেকে মুক্ত কিন্তু প্রায় মানুষের কাছাকাছি বুদ্ধিমান কিছু একটা তৈরি করার সময় এক সময় রবোটকে সৃষ্টি করা হয়েছিল, কিন্তু যদি তাদের ক্ষুধা তৃষ্ণা ফিরিয়ে দেয়া হয় তাহলে কি মানুষ রবোট সম্পর্কে তার মূল লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে যাবে না?
আবদুল্লাহ কথা থামিয়ে হঠাৎ একটু এগিয়ে এসে বলল, আমি বেশ অনেকক্ষণ থেকে লক্ষ করছি আপনি কিন্তু কিছুই খাচ্ছেন না।
নাসরীন উত্তরে কী একটা বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই জাহিদ মুখভরা খাবার নিয়ে অস্পষ্ট গলায় বলল, এই শালা তো দেখি খালি নামেই রবোট। কথাবার্তায় তো দেখি ক্যাসানোভা!
জাহিদের কথা বলার ভঙ্গিটি ছিল কদর্য, নাসরীন আহত দৃষ্টিতে খানিকক্ষণ স্থির চোখে জাহিদের দিকে তাকিয়ে থেকে আবদুল্লাহকে বলল, তুমি কিছু মনে কোরো না আবদুল্লাহ। আমার স্বামীর মানসিক পরিপক্কতা খুব বেশিদূর যেতে পারে নি। এগার–বার বছরের কাছাকাছি গিয়ে হঠাৎ করে থেমে গেছে।
জাহিদ নাসরীনের কথা শুনে হঠাৎ ভিডি রিডার থেকে চোখ তুলে একবার আবদুল্লাহর দিকে তাকাল এবং একবার নাসরীসের দিকে তাকাল, তারপর উচ্চৈঃস্বরে হাসতে হাসতে বলল, তোমার নিশ্চয়ই মাথা খারাপ হয়ে গেছে। এটা মানুষ না, এটা যন্ত্র। এর সাথে ভদ্রতা করার কোনো দরকার নেই, এর ভিতরে আছে লোহালক্কড় টিউব ব্যাটারি যন্ত্রপাতি
নাসরীন নিচু গলায় বলল, তার সাথে অভদ্রতা করারও কোনো দরকার নেই। তুমি শুনেছ সে নিজেই বলেছে তার ভিতরে এক ধরনের অনুভূতি রয়েছে।
বিছানায় শুয়েই জাহিদ ঘুমিয়ে পড়ে, আজকেও তাই হল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে পড়ল। নাসরীন দীর্ঘ সময় অন্ধকারে একা একা শুয়ে থাকে। পাশের ঘরে একজন একা একা বসে আছে চিন্তা করে তার কেমন জানি অস্বস্তি হতে থাকে, মানুষটা একা একা কী করছে কে জানে। বিছানায় শুয়ে অনেকক্ষণ এপাশ ওপাশ করে শেষ পর্যন্ত সে বিছানা থেকে নেমে এল। নাসরীন হালকা পায়ে হেঁটে পাশের ঘরে এসে দাঁড়াল। ঘরে আবছা অন্ধকার, জানালা দিয়ে চাঁদের আলো এসেছে ঘরে, সেই আবছা আলোয় দেখা যাচ্ছে আবদুল্লাহ পাথরের মূর্তির মতো বইয়ের শেলফের কাছে বসে আছে। নাসরীন মৃদু গলায় বলল, অন্ধকারে তুমি কী করছ?