বব লাস্কির মুখ ফ্যাকাশে হয়ে আসে। শওকত তার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি এত ভয় পাচ্ছ কেন? শওকত নিশ্চয়ই আসবে তোমাকে মুক্ত করতে। তোমাকে এভাবে এখানে আটকে রেখে কখনোই চলে যাবে না।
পরাবাস্তবতার জগতে শওকতের একটি কাল্পনিক রূপ হঠাৎ কেমন জানি বিভ্রান্ত হয়ে যায়। মাথা ঘুরে বব লাস্কির দিকে তাকিয়ে বলল, শওকত ভালো আছে তো?
বব লাস্কি কোনো কথা বলল না, মাথা নিচু করে বসে রইল। ধরাছোঁয়ার বাইরে এক পরাবাস্তবতার জগতে।
বিকল্প
দরজা খুলে নাসরীন দেখল জাহিদের পিছনে আরেকজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে এবং মানুষটির চেহারা অস্বাভাবিক সুন্দর, শুধুমাত্র সিনেমার পত্রিকাতেই এ রকম সুন্দর চেহারার মানুষ দেখা যায়। জাহিদের সাথে একটু আগেই ভিডিফোনে কথা হয়েছে, সে সাথে আরো কাউকে নিয়ে আসবে বলে নি। বললে ঘরটা একটু গুছিয়ে রাখা যেত, সে নিজেও চট করে শাড়িটা পাল্টে নিতে পারত। নাসরীন মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, জাহিদ ইচ্ছে করে তার সাথে এ রকম ব্যবহার করে। এ রকম সুপুরুষ একজন মানুষের সামনে সে এভাবে জবুথবু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ভেবে তার নিজের উপরেই কেমন জানি রাগ উঠে যায়।
জাহিদ নাসরীনকে পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকল, সে যে দরজায় দাঁড়িয়ে আছে সেই ব্যাপারটিও যেন তার চোখে পড়ে নি। সুপুরুষ মানুষটা কী করবে বুঝতে না পেরে জাহিদের পিছনে পিছনে ঘরে এসে ঢুকল, তার চোখেমুখে হতচকিত একটা ভাব।
জাহিদ টেবিলে ব্রিফকেসটা রেখে টাইয়ের গিটটা একটু ঢিলে করতে করতে বলল, আমার একটা জরুরি ভিডিফ্যাক্স আসার কথা ছিল।
নাসরীন মুখ শক্ত করে বলল, এসেছে।
ভিডিফ্যাক্সের কথা শুনে জাহিদের মুখের চেহারা একটু নরম হয়ে আসে। সে মাথা নেড়ে বলল, গুড। আমাকে এক গ্লাস পানি দাও তো
নাসরীন নিজের ভিতরে এক ধরনের ক্রোধ অনুভব করে, ইচ্ছে হল বলে তুমি নিজে ঢেলে নাও। কিন্তু ঘরে একজন বাইরের মানুষ দাঁড়িয়ে আছে, সে কিছু বলল না। ফ্রিজের কাছে গিয়ে বোতাম টিপে এক গ্লাস পানি বের করে এনে দেয়। জাহিদ পানিটা ঢকঢক করে খেয়ে গলা দিয়ে এক ধরনের বিশ্রী শব্দ করল। নাসরীন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারে না যে একজন বাইরের মানুষের সামনে জাহিদ এ রকম একটা আচরণ করতে পারে। সে নিজেকে অনেক কষ্টে শান্ত করে বলল, ইনি কে?
জাহিদ মাথা ঘুরে তাকাল, যেন সে বুঝতে পারছে না নাসরীন কার কথা বলছে। সুপুরুষ মানুষটির দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, এই?
হযা। নাসরীন শান্ত গলায় বলল, তুমি এখনো আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দাও নি
জাহিদ উত্তর না দিয়ে হা হা করে হাসতে থাকে এবং এক সময় হাসি থামিয়ে বলল, এটাকে তুমি মানুষ ভেবেছ?
নাসরীন হকচকিয়ে গেল, বলল, তাহলে
এটা রবোট।
নাসরীন অবাক হয়ে সুপুরুষ মানুষটার দিকে তাকাল এবং হঠাৎ করে তার কেন জানি এক ধরনের আশাভঙ্গের অনুভূতি হয়। সে আবার তার বুকের ভিতরে একটি নিশ্বাস ফেলল, তার আগেই বোঝা উচিত ছিল, এ রকম নিখুঁত সুপুরুষ একজন মানুষ সত্যি সত্যি পাওয়া যায় না, তাকে তৈরি করতে হয়।
মনে নেই আমি বলেছিলাম আমাদের জিএম ইমতিয়াজ সাহেব বলেছিলেন আমাকে। একটা রবোট দেবেন, ট্রায়াল হিসেবে।
নাসরীন একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, বল নি।
বলি নি? জাহিদ অবাক হবার এক ধরনের দুর্বল অভিনয় করার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়ে বলল, ভেবেছিলাম বলব। ভুলে গেছি।
কী বলতে ভুলে গিয়েছিলে? এখন বলবে?
আমাদের লোকাল ফ্যাক্টরিতে রবোট এসেম্বলি করছে, ট্রায়াল হিসেবে প্রথমে আমাদের নিজেদের মাঝে রবোটগুলো দিচ্ছে।
কেন?
জাহিদ অকারণে একটা হাই তুলল, বোঝা যাচ্ছে তার কথা বলার বিশেষ ইচ্ছে নেই। এটি নতুন নয়, দীর্ঘদিন থেকে সে নাসরীনের সাথে এ রকম ব্যবহার করে আসছে। নাসরীন কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে আবার জিজ্ঞেস করল, কেন?
জাহিদ নেহাত অনিচ্ছার সাথে বলল এতদিন ফ্যাক্টরিতে এসেম্বলি লাইনে টেকনিক্যাল কাজে ব্যবহার করেছে। এখন দেখতে চায় গৃহস্থালি পরিবেশে ব্যবহার করা যায় কি না। আমাকে একটা দিয়েছে কয়দিন বাসায় রাখার জন্যে।
তোমাকে কেন?
কারণ আমাদের জিএম ইমতিয়াজ সাহেব আমাকে পছন্দ করেন। তাছাড়া
তাছাড়া কী?
আমি সিকিউরিটি ডিভিশনের মানুষ। কোনো ইমার্জেন্সিতে রবোটটাকে কিছু করতে হলে আমি করতে পারব। আমার কাছে ইমার্জেন্সি কোড রয়েছে।
জাহিদ নিচু হয়ে জুতোর ফিতা খুলতে গিয়ে হঠাৎ কী মনে করে থেমে যায়। সে তার পা উপরে তুলে সুপুরুষ মানুষটার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল, খোল দেখি জুতোটা।
নাসরীন কেমন জানি শিউরে ওঠে, কিন্তু রবোট মানুষটার কোনো ভাবান্তর হল না। সে এগিয়ে এসে হাঁটু গেড়ে বসে জাহিদের জুতোর ফিতে খুলতে শুরু করে। একজন অত্যন্ত সুদর্শন মানুষ–হোক–না সে রবোট, নিচু হয়ে আরেকজনের পায়ের জুতো খুলে দিচ্ছে ব্যাপারটা অত্যন্ত দৃষ্টিকটু। জাহিদ হাসি হাসিমুখে নাসরীনের দিকে তাকিয়ে বলল, এর নাম হচ্ছে আবদুল্লাহ।
আবদুল্লাহ?
সাথে সাথে রবোটটি নাসরীনের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে বলল, জি। এখন আমার নাম আবদুল্লাহ।
রবোটটির গলার স্বর অপূর্ব, মনে হয় দীর্ঘদিন রেওয়াজ করে ভোকাল কর্ডে সুর বাধা হয়েছে। নাসরীন জিজ্ঞেস করল, এখন আপনার নাম আবদুল্লাহ? আগে অন্য নাম ছিল?