বব লাস্কি চেয়ারে বসে মাথায় হেলমেটটা পরে নেয়, সাথে সাথে তার চোখের সামনে একটি নতুন জগৎ খুলে যায়। বিশাল একটি নির্জন ঘর, ঘরের দেয়ালে কারুকাজ, ঘরের ছাদ থেকে ঝুলছে ঝাড়লণ্ঠন। ঘরের ভিতরে সুনসান নীরবতা– বাইরে মনে হয় উদ্দাম বাতাস দরজায় মাথা কুটছে। বব লাস্কি অন্যমনস্কভাবে দুই এক পা হাঁটল, নিজের পায়ের শব্দ শুনে নিজেই কেমন জানি চমকে ওঠে। ডান পাশে আরো একটি ঘর, কী আছে এই ঘরের ভিতর? বব লাস্কি হেঁটে গিয়ে দরজায় হাত রাখল। সাথে সাথে ভিতর থেকে একজন বলল, কে?
বব লাস্কি চমকে উঠল, থতমত খেয়ে বলল, আমি।
আমি কে?
আমি বব লাস্কি।
বব লাস্কি? কী চাও তুমি?
কিছু না। বব লাস্কি দরজা ধাক্কা দিয়ে খুলে ফেলল, ভিতরে গাঢ় অন্ধকার, কিছু দেখা যায় না। ধোঁয়ার মতো কুয়াশা পাক খেয়ে বেড়াচ্ছে। সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল, হঠাৎ কে যেন মাটি ফুঁড়ে বের হয়ে আসে। দীর্ঘ দেহ, মাথায় এলোমেলো চুল। বব লাস্কির দিকে তাকাল, কী ভয়ানক তীব্র তার দৃষ্টি। মানুষটি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকে, সেই চোখে কি ঘৃণা আর ক্রোধ? বব লাস্কি কেন জানি সহ্য করতে পারল না, দুই হাতে ধরে মাথা। থেকে হেলমেটটি খুলে ফেলে। সাথে সাথে আবার শওকতের বৈচিত্র্যহীন ল্যাবরেটরি ঘরটায় ফিরে আসে। টেবিলের উপর র্যাকের মাঝে যন্ত্রপাতি, একটা বড় মনিটর কি–বোর্ড। মেঝেতে পড়ে থাকা শওকতের মৃতদেহ। বব লাস্কি মাথা ঘুরিয়ে মৃতদেহটির দিকে তাকাল এবং হঠাৎ করে সে ভূত দেখার মতো চমকে উঠল– সেখানে কিছু নেই। কোথায় গিয়েছে মৃতদেহটি? বব লাস্কি লাফিয়ে উঠে দাঁড়ায় এবং হঠাৎ করে চোখের সামনে সবকিছু কেমন জানি দুলে ওঠে। টেবিলটা ধরে সে কোনোমতে নিজেকে সামলে নেয়। ভয়ে ভয়ে তাকায় চারদিকে, কিছু একটা বিচিত্র ব্যাপার ঘটেছে এখানে কিন্তু সে ঠিক বুঝতে পারছে না। পায়ে পায়ে হেঁটে সে জানালার কাছে দাঁড়ায়। ওই তো বাইরে দুটো নারকেল গাছ, একটা বাজ পড়ে পুড়ে গেছে। লোহার গেট। ছোট ইটের রাস্তা। সবকিছু আগের মতোই আছে কিন্তু কিছু একটা যেন অন্যরকম। সেটা কী?
বব লাস্কির গলা শুকিয়ে যায় হঠাৎ কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে ওঠে, কী হয়েছে এখানে?
খুট করে একটা শব্দ হল পিছনে, চমকে ঘুরে তাকাল বব লাস্কি এবং হঠাৎ একেবারে জমে গেল পাথরের মতন। ঘরের দরজায় শওকত দাঁড়িয়ে আছে। তার শরীরে গুলির কোনো চিহ্ন নেই। সুস্থ সবল একজন মানুষ।
বব লাস্কি শওকতকে দেখে যত অবাক হয়েছিল, শওকত ঠিক ততটুকু অবাক হল তাকে দেখে। উৎকণ্ঠিত গলায় বলল, তুমি কে? কেন এসেছ এখানে?
বব লাস্কি কোনো কথা বলল না, বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইল শওকতের দিকে। হঠাৎ তার একটা বিচিত্র সন্দেহ হতে শুরু করেছে। শওকত আরো এক পা এগিয়ে এসে বলল, তুমি জান খুব বড় একটা গোলমাল হয়েছে কোথাও। খুব খুব বড় গোলমাল?
কী গোলমাল?
আমি জানি না। কিন্তু আমার সাথে এই ঘরে যদি কারো দেখা হয়, তার মানে খুব বড় গোলমাল হয়েছে। মূল প্রোগ্রাম এখন কেটে দেয়া হয়েছে, আমরা সবাই চলে গেছি নিরাপত্তার অংশে।
কী বলছ তুমি?
তুমি নিশ্চয়ই জান এটি ভারচুয়াল রিয়েলিটির প্রোগ্রাম। জান?
বব লাস্কি আতঙ্কে শিউরে উঠে দুই হাতে নিজের মাথায় হাত দিয়ে হেলমেটটি আবার খুলে ফেলার চেষ্টা করে কিন্তু সেখানে কিছু নেই।
.
শওকত মাথা নাড়ল, বলল, না তুমি এখন এই প্রোগ্রামের বাইরে যেতে পারবে না। তোমাকে এখন এখানে থাকতে হবে।
কতক্ষণ থাকতে হবে?
সারা জীবন।
সারা জীবন?
হ্যাঁ। প্রোগ্রামের এই অংশটি সারা জীবন চলার কথা। কেউ নিজে থেকে এর বাইরে যেতে পারে না।
বিশ্বাস করি না আমি বিশ্বাস করি না! বব লাস্কি চিৎকার করে বলল, আমি কিছু বিশ্বাস করি না।
কিছু আসে যায় না তাতে। শওকত বিষণ্ণ গলায় বলল, তুমি বিশ্বাস না করলে কিছু আসে যায় না। আমরা এখন এই ছোট ঘরটায় আটকা পড়ে গেছি।
বব লাস্কি প্রাণপণে নিজের মাথায় অদৃশ্য একটা হেলমেটকে টেনে আলাদা করতে চায় কিন্তু কোনো লাভ হয় না। শওকত এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে বব লাস্কির দিকে তাকিয়ে থাকে। যখন বব লাস্কি হাল ছেড়ে দিয়ে মাটিতে বসে পড়ে সে নরম গলায় বলল, আমি তোমার জন্যে খুব দুঃখিত, কিন্তু সত্যি তোমার কিছু করার নেই। তোমাকে এখন এখানে থাকতে হবে।
বব লাস্কি উঠে গিয়ে টেবিলের উপর র্যাকটি ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়, মনিটরটাকে তুলে আছড়ে ফেলে মেঝেতে–হ্যাচকা টান দিয়ে পাওয়ার কর্ডটি খুলে আনে। শওকত আবার নরম গলায় বলল, তুমি জান এইসব কম্পিউটারে তৈরী কল্পনার জগৎ। এগুলো সত্যি নয়। এগুলো ভেঙে না–ভেঙে কোনো লাভক্ষতি নেই।
বব লাস্কি বিস্ফারিত চোখে তাকাল শওকতের দিকে। শওকত প্রায় কোমল গলায় বলল, তোমার নাম কী?
বব লাস্কি
বব লাস্কি! তুমি তোমার শক্তি অপচয় কোরো না। একটু পরে তোমাকে নিতে আসবে অন্ধকার জগতের মানুষেরা।
কারা?
অন্ধকার জগতের মানুষ। ভালবাসাহীন অত্যন্ত নিষ্ঠুর কিছু মানুষ।
কী করবে তারা আমাকে?
আমি জানি না। শওকত নিশ্বাস ফেলে বলল, আমি জানতেও চাই না।
সেখান থেকে আমি বের হতে পারব না কখনো?
পারবে। অবশ্যি পারবে। যখন সত্যিকারের শওকত এসে প্রোগ্রামটি বন্ধ করে দেবে, তুমি বের হয়ে আসবে আবার।