বব লাস্কি উৎসাহী চোখে বলল, হ্যাঁ আমি পুরোটা দেখতে চাই
বেশ। শওকত একটু এগিয়ে এসে বলল, তুমি এই চেয়ারটাতে বস, বসে মাথায় হেলমেটটি লাগিয়ে নাও।
বব লাস্কি চেয়ারটাতে বসে হেলমেটটা ভালো করে দেখে। চোখের সামনে ছোট ছোট দুটি লেন্স, তার পেছনে তিনটি এল. ই. ডি.। নিশ্চয়ই সেখান থেকে সরাসরি চোখে আলো পাঠিয়ে দেখার অনুভূতি দেয়া হয়। কানের কাছে দুটি বড় এবং সংবেদনশীল হেডফোন। চেয়ারের হাতলে হাত রাখার জায়গা, হাতের অনুভূতিটা সেখান থেকে আসবে। বব লাস্কি সাবধানে হেলমেটটা পরে নেয়। সাথে সাথে চারদিক অন্ধকার হয়ে আসে, নৈঃশব্দ্য আড়াল করে নেয় সবকিছু। বহুদূর থেকে হঠাৎ শওকতের গলার স্বর ভেসে আসে, তুমি কি প্রস্তুত বব?
হ্যাঁ।
হাত দুটি সরিও না এখন। আমি চালু করছি।
কর।
যদি কোনো কারণে তুমি ভারচুয়াল জগৎ থেকে বের হয়ে আসতে চাও, মাথা থেকে হেলমেটটি খুলে নিও। আমি অবশ্যি কাছেই দাঁড়িয়ে থাকব, আমাকে বলতে পার।
ঠিক আছে।
তুমি প্রস্তুত?
হ্যাঁ।
আমি চালু করছি।
টুক করে একটা শব্দ হল। সাথে সাথে একটা ভোতা গুঞ্জন শোনা যেতে থাকে। চোখের সামনে বিচিত্র কিছু রং খেলা করছে, ধীরে ধীরে সেখানে একটা অস্পষ্ট ছবি ভেসে আসে। ছবিটা চোখের সামনে কয়েকবার দুলে হঠাৎ স্থির হয়ে যায়, তারপর সেটা স্পষ্ট হতে শুরু করে। বব লাস্কি নিশ্বাস বন্ধ করে দেখে সে একটা বিশাল ঘরে দাঁড়িয়ে আছে। প্রাচীন একটা উপাসনালয়ের মতো চারপাশে দেয়ালে কারুকাজ। উপরে ছাদে বিচিত্র আলোর ঝাড়লণ্ঠন ঝুলছে। দুপাশে কাঠের দরজা। বাইরে বাতাসের গর্জন। বব লাস্কি নিশ্বাস বন্ধ করে এই রহস্যময় ঘরটিতে দাঁড়িয়ে থাকে, কী ভয়ঙ্কর রকম বাস্তব অনুভূতি। এটি সত্যিকারের ঘর নয়, এটি দক্ষ সফটওয়ারে তৈরী একটি অনুভূতি, পুরোটা একটি কাল্পনিক ছবি কিন্তু পুরোটা এত বাস্তব যে ব্যাপারটি অবিশ্বাস্য। বব লাস্কি ডান দিকে তাকাল, সাথে সাথে প্রাচীন উপাসনালয়ের মতো ঘরটির ডান দিকের অংশটি দেখতে পায়। মাথা ঘুরিয়ে বাম দিকে তাকাল, একটা করিডোর বহুদূরে চলে গেছে।
বব লাস্কি অভিভূত হয়ে এই অতিপ্রাকৃত সৌন্দর্যের দিকে তাকিয়ে থাকে। সে ভারচুয়াল রিয়েলিটির অসংখ্য সফটওয়ার পরীক্ষা করেছে কিন্তু এর সাথে তুলনা করার মতো কখনো কিছু দেখে নি। এ রকম কিছু একটা যে তৈরি করা যায় নিজের চোখে না দেখলে সে কখনো বিশ্বাস করত না। এত বাস্তব অনুভূতি যে তার মনে হতে থাকে হাতটি চোখের সামনে তুলে ধরলে সেই হাতটিও দেখতে পাবে। ব্যাপারটি সম্ভব নয় জেনেও সে হাতটি চোখের সামনে আনে সাথে সাথে বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে ওঠে। সে তার হাতটাকে দেখতে পাচ্ছে! কী আশ্চর্য! সে অন্য হাতটিও সামনে এনে ধরে। তারপর নিজের শরীরের দিকে তাকায়। এই তো তার শরীর হাত পা! কারুকাজ করা কাঠের একটা চেয়ারে বসে আছে সে। সে কি নিজের শরীর স্পর্শ করতে পারবে? অনিশ্চিতের মতো সে নিজেকে স্পর্শ করে। সাথে সাথে সে স্পর্শ করার অনুভূতিটি টের পায়। কী আশ্চর্য! কী করে করেছে এটি শওকত?
বব লাস্কি এবার দাঁড়াতে চেষ্টা করে, প্রথমে মনে হয় সারা পৃথিবী দুলে উঠেছে কিন্তু কিছুক্ষণেই সব স্থির হয়ে যায়। সত্যি সত্যি কি সে দাঁড়িয়েছে নাকি এটি দক্ষ সফটওয়ারে তৈরী দাঁড়ানোর একটা অনুভূতি? বব লাস্কি এক পা এগিয়ে যায়, সত্যি সত্যি সে প্রাচীন এই ঘরের মাঝে হাঁটছে। কেউ যদি এত বাস্তব অনুভূতির জন্ম দিতে পারে তাহলে বাস্তব আর কল্পনার মাঝে পার্থক্য কোথায়? স্বপ্ন আর সত্যি কি ভিন্ন জিনিস? বব লাস্কি কৌতূহলী চোখে করিডোর ধরে হাঁটতে থাকে। বহুদূরে একটা কাঠের দরজা। সে কি হেঁটে যাবে দরজার কাছাকাছি, খুলে দেখবে কী আছে দরজার অন্য পাশে?
বিশাল নির্জন একটা উপাসনাকক্ষে বব লাস্কি হেঁটে যেতে থাকে। মসৃণ দেয়ালে নিজের ছায়া পড়েছে, ঘরের নৈঃশব্দ্য ভেঙে যাচ্ছে তার পায়ের শব্দে। দরজার কাছাকাছি এসে সে সাবধানে হাতল ধরে খুলে ফেলে, নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে হঠাৎ! পৃথিবীর বাইরের কোনো এক নীল হ্রদ, সেই হ্রদের পানিতে ছায়া পড়ছে চাঁদের, নরম আলোতে কী অপূর্ব মায়াময় লাগছে। দূরে পাইনগাছের সারি, বাতাসে দুলছে সেই গাছ। কী অপূর্ব! বব লাস্কি বিশ্বাস করতে পারে না এই সবকিছু কল্পনা, একজন মানুষের হাতে তৈরী একটা কাল্পনিক জগৎ। অবিশ্বাস্য এক দৃশ্য।
মাথায় হাত দিয়ে সে হেলমেটটি খুলে ফেলল, সাথে সাথে কল্পনার জগৎ অদৃশ্য হয়ে গেল। বড় একটা টেবিলের কিছু যন্ত্রপাতির সামনে একটা গদি–আঁটা চেয়ারে বসে আছে সে, তার সামনে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শওকত। বব লাস্কি বিস্মিত চোখে হেলমেটটার দিকে তাকিয়ে থাকে। এখনো তার বিশ্বাস হচ্ছে না। সে মাথা নেড়ে বলল, কী আশ্চর্য!
শওকত একটু এগিয়ে আসে, কী হয়েছে বব?
এখনো আমার বিশ্বাস হচ্ছে না, সত্যিই কি আমি দেখেছি?
হ্যাঁ, দেখেছ। বিশ্বাস না হলে আবার মাথায় দাও হেলমেটটা।
বব কাঁপা হাতে হেলমেটটা মাথায় দিতেই আবারর সেই বিচিত্র জগৎ চোখের সামনে ফিরে আসে। নীল হ্রদে চাঁদের ছায়া পড়ে চকচক করছে রুপালি আলো। পাইনগাছ নড়ছে মৃদু বাতাসে। রাতজাগা একটা পাখি ডেকে ডেকে উড়ে গেল মাথার উপর দিয়ে। দরজার দিকে তাকাল সে, ভিতরে বিশাল উপাসনাকক্ষের মতো একটা ঘর, নৈঃশব্দ্যে ডুবে আছে। বব লাস্কি দুই পা হেঁটে যায় ভিতরে চারদিকে কী আশ্চর্য সুনসান নীরবতা। বব লাস্কি মাথা থেকে হেলমেটটা খুলে ফেলল আবার, সাথে সাথে ফিরে এল বৈচিত্র্যহীন সাদাসিধে একটা ল্যাবরেটরিতে। গদি–আঁটা চেয়ারে বসে আছে সে।