ত্রাতিনা বিভ্রান্তের মতো বলল, কিন্তু আমার মনে হয় আগের জীবনই ভালো ছিল, যখন আমরা বাইরে যেতাম। কিছু একটা স্পর্শ করতাম–দেখতাম–
ক্রিটন নরম গলায় হাসল, বলল, দুটির মাঝে কোনো পার্থক্য নেই। তোমার মস্তিষ্ক যেটা অনুভব করে সেটা সত্যিকারের অনুভূতি
কিন্তু–কিন্তু–ত্রাতিনা কী বলবে বুঝতে পারে না। খানিকক্ষণ চেষ্টা করে বলল, আমি কি তোমাকে একবার দেখতে পারি?
নিশ্চয়ই পারবে। তুমি যখন পৃথিবীতে আসছ অবশ্যি আমাকে দেখবে। আমাদের সবাইকে দেখবে।
এখন কি দেখতে পারি?
এখন?
হ্যাঁ।
ক্রিটন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, বেশ দেখ। প্রথমে তোমার একটু অস্বাভাবিক মনে হতে পারে কিন্তু খুব সহজেই তোমার অত্যাস হয়ে যাবে। এই যে আমি–
ত্রাতিনা বিশাল মনিটরে একটি মস্তিষ্ক দেখতে পেল। থলথলে মস্তিষ্কটি এক ধরনের তরল পদার্থে ভেসে আছে, আশপালে কয়েকটি টিউব লাগানো রয়েছে, যেগুলো দিয়ে মস্তিকটিতে পুষ্টিকর তরল আসছে।
ত্রাতিনা একবার আর্তনাদ করে ওঠে, ক্রিটন নরম গলায় বলল, এইটা আমি। আমাদের শরীরের সব বাহুল্য দূর করে দেয়া হয়েছে–হাত পা মুখ চোখ জননেন্দ্রীয় কিছু নেই। শুধু মস্তিষ্ক। সেই মস্তিষ্কে সত্যিকারের অনুভূতি সেটা দেয়ার জন্যে রয়েছে আধুনিক যোগাযোগ মডিউল।
ত্রাতিনার হঠাৎ মাথা ঘুরে ওঠে, সে কোনোভাবে দেয়াল ধরে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। ক্রিটন নরম গলায় বলল, পৃথিবীর সব মানুষ এখন থাকে কাছাকাছি, নিরাপদ ভল্টে, তাদের জন্যে নির্ধারিত কিউবিকেলে। তুমি যখন আমাকে দেখেছ এখন নিশ্চয়ই অন্যদেরকেও দেখতে চাইবে। এই যে দেখ আমাদের–
ত্রাতিনা বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকে, দেখতে পায় বিশাল হলঘরে সারি সারি চতুষ্কোণ পাত্রে থলথলে মস্তিষ্ক সাজানো। একটির পর আরেকটি তারপর আরেকটি। মানুষের সভ্যতা শিল্প সাহিত্য জ্ঞান বিজ্ঞান প্রেম ভালবাসা দুঃখ বেদনা সব লুকিয়ে আছে ওইসব থলথলে মস্তিষ্কের ভিতরে।
ত্রাতিনা আতঙ্কিত চোখে কিছুক্ষণ মনিটরটির দিকে তাকিয়ে রইল তারপর মাথা ঘুরিয়ে কন্ট্রোল প্যানেলের দিকে তাকাল। সেখানে লাল একটি সুইচ জ্বলছে এবং নিভছে। সে বুক ভরে একবার নিশ্বাস নিল তারপর হাত বাড়িয়ে দিল সুইচটার দিকে।
রাবাস্তবতার জগতে
হাতের চিরকুটের সাথে ঠিকানা মিলিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল বব লাস্কি। এটাই সেই বাসা, ১৯/৭ কাঁঠালীচাপা লেন। হলুদ রঙের একতালা দালান। বাসার সামনে দুটি নারকেলগাছ, তার মাঝে একটি বাজ পড়ে পুড়ে গেছে ঠিক যেরকম তাকে বলে দেয়া হয়েছিল। বাসাটি দেখে বব লাস্কির এক ধরনের বিস্ময় হয়, যেই মানুষটির জন্যে সুদূর ক্যালিফোর্নিয়া থেকে একটা এটাচি কেস ভরে এক মিলিয়ন ডলার নিয়ে এসেছে তার বাসাটি সে আরেকটু সুন্দর হবে আশা করেছিল। সে তার বিস্ময়টুকু দ্রুত ঝেড়ে ফেলে গেট খুলে ভিতরে ঢুকে যায়, এই পুরো ব্যাপারটি এত অবাস্তব যে এখন সেটা নিয়ে অবাক হবার সময় পার হয়ে গিয়েছে।
গেটের ভিতরে একটা ছোট রাস্তা, রাস্তার দুপাশে অযত্নে বেড়ে ওঠা কিছু ফুলগাছ। বব লাস্কি রাস্তা ধরে হেঁটে বারান্দার উপর দাঁড়াল, বাইরে একটা কলিংবেল থাকার কথা, সেটা খুঁজে বের করে চেপে ধরতেই ভিতরে একটা কর্কশ আওয়াজ হতে থাকে। প্রায় সাথে সাথেই দরজা খুলে যায়। ভিতরে আবছা অন্ধকার, সেখানে একজন দীর্ঘকায় মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। মানুষটি মধ্যবয়সী, মাথার চুলে পাক ধরেছে, চোখে ভারি চশমা। চশমার আড়ালে চোখ দুটি আশ্চর্য রকম স্বচ্ছ। এই দেশের মানুষের চেহারায় যেরকম এক ধরনের কোমলতা রয়েছে এই মানুষটিরও তাই কিন্তু পোশাকটি নিঃসন্দেহে পাশ্চাত্য দেশের, একটি জীর্ণ ব্লু জিনস এবং রং ওঠা টি–শার্ট!
বব লাস্কি হাত বাড়িয়ে বলল, আমার নাম বব লাস্কি। তুমি নিশ্চয়ই ‘শাউক্যাট’?
দীর্ঘকায় মানুষটি হাত মিলিয়ে একটু হেসে বলল, শাউকাট নয়, শব্দটি বাংলায় উচ্চারণ করা হয় শওকত!
বব লাস্কি একটু থতমত খেয়ে আবার চেষ্টা করল, শওকাট?
শওকত নামের মানুষটি মাথা নেড়ে বলল, অনেকখানি হয়েছে, এতে বেশ কাজ চলে যাবে। ইংরেজিতে ‘ত’ উচ্চারণ নেই, তুমি সেটা শুনতেই পাও না, বলবে কেমন করে? এস, ভিতরে এস।
বব লাস্কি লক্ষ করল শওকতের ইংরেজি উচ্চারণে আঞ্চলিকতার কোনো ছাপ নেই, কথা বুঝতে কোনো অসুবিধে হয় না। সে ধন্যবাদ দিয়ে ভিতরে ঢোকে। ঘরের ভিতরে আসবাবপত্র খুব কম, একটা কালো টেবিল এবং সেটা ঘিরে কয়েকটা চেয়ার, আর কিছু নেই। বব লাস্কি তার এটাচি কেসটা কোথাও রাখবে কি না বুঝতে পারল না। ভিতরে এক শ ডলারের নোটে এক মিলিয়ন ডলার ধরে রেখে–রেখে হাত ব্যথা হয়ে গেছে। শওকত তাকে বসার ইঙ্গিত করে বলল, তুমি কে এবং কোথা থেকে এসেছ অনুমান করতে কোনো অসুবিধে হচ্ছে না কিন্তু তবু তোমার মুখে একবার শুনি।
বব লাস্কি একটা চেয়ারে বসে এটাচি কেসটা নিজের কোলের উপর রেখে বলল, অবশ্যি অবশ্যি। শুরু করার আগে আমি গোপন সংখ্যাটি বলে নিই যেন তুমি নিশ্চিত হতে পার। সংখ্যাটি হচ্ছে–বব এক মুহূর্ত চিন্তা করে বলল, আট শ ছিয়ানব্বই হাজার দুই শ দুই। ঠিক হয়েছে?
হয়েছে। শওকত একটু হেসে বলল, সংখ্যাটি হেক্সা ডেসিমেলে হয় ‘ঢাকা’! আমার খুব প্রিয় শহর।