ক্রিক জিজ্ঞেস করল, কী কথা?
রিফা যেরকম বলছে প্রাচীনকালের মানুষ কেমন করে বেঁচে থাকত তার জানতে খুব ইচ্ছে করে, আমারও সেরকম ইচ্ছে করে। ব্যাপারটি সহজ নয় কিন্তু একেবারে অসম্ভবও তো নয়।
রিফা ঘুরে তাকাল লনের দিকে, চোখ বড় বড় করে বলল, কীভাবে?
লন আঙুল দিয়ে দূর পাহাড়ের একটা চুড়োর দিকে দেখিয়ে বলল, ওই যে চুড়োটা
দেখছ সেটা এখান থেকে প্রায় ষাট কিলোমিটার দূরে। চুড়োটার নিচে একটা চমৎকার উপত্যকা রয়েছে। আমরা যদি এখান থেকে ওদিকে যেতে শুরু করি, মনে হয় দুদিনে পৌঁছে যাব। বনে জঙ্গলে পাহাড়ে পর্বতে আমাদের হেঁটে অভ্যাস নেই তাইনা হয় অনেক আগে পৌঁছে যেতাম।
ক্রিক ভুরু কুঁচকে বলল, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না তুমি কী বলতে চাইছ।
লন একটু হাসার মতো ভঙ্গি করে বলল, আমি বলছি চল আমরা সবাই মিলে পাহাড়ের নিচে সেই উপত্যকাটায় যাই।
ক্রিক মাথা নেড়ে বলল, আমি এখনো ঠিক বুঝতে পারছি না। আমরা যদি উপত্যকাটায় যাই তাহলে কেন সেটা প্রাচীনকালের মানুষের মতো যাওয়া হবে? আমাদের পায়ের জুতো লেভিটেটিং প্রয়োজনে আমাদের ভাসিয়ে নিতে পারে, আমাদের জামাকাপড় নিও পলিমারের, তার মাঝে হাই জি সেন্সর রয়েছে, হঠাৎ করে পড়ে গেলে নিজে থেকে রক্ষা করে, আমাদের হেলমেটে-
লন বাধা দিয়ে বলল, আমরা সে সবকিছু রেখে যাব। সাধারণ একজোড়া জুতো পরে, সাধারণ কাপড়ে হেঁটে হেঁটে যাব। সাথে থাকবে কিছু খাবার আর স্লিপিং ব্যাগ। আর কিছু না।
কেউ কোনো কথা না বলে বিস্তারিত চোখে লনের দিকে তাকিয়ে রইল। রিফা খানিকক্ষণ চেষ্টা করে বলল, আর কিছু না?
না। সবার কাছে প্রাচীন কোনো অস্ত্র থাকতে পারে। একটা ছোরা বা কুড়াল, এর বেশি কিছু নয়।
যদি বুনো পশু আমাদের আক্রমণ করে?
করার কথা নয়। তবু যদি করে আমরা আমাদের অস্ত্র দিয়ে নিজেদের রক্ষা করব।
যদি পা হড়কে পড়ে যাই? গভীর ধাদের মাঝে পড়ে যাই?
তাহলে মরে যাব।
রিফা শিউরে উঠে বলল, মরে যাব?
হ্যাঁ। তাই চেষ্টা করব যেন পা হড়কে পড়ে না যাই। খুব সাবধানে আমরা যাব, একে অন্যকে রক্ষা করে।
যদি কোনো জরুরি প্রয়োজন হয়? আমাদের কমিউনিকেশান মডিউল–
না, আমাদের কাছে কমিউনিকেশান মডিউলও থাকবে না। এখানে ফিরে না আসা পর্যন্ত আমরা কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারব না। যদি জরুরি কোনো প্রয়োজন হয় আমাদের নিজেদের সেই প্রয়োজন মেটাতে হবে। প্রাচীনকালের মানুষেরা যেভাবে মেটাত।
সবাই চুপ করে লনের দিকে তাকিয়ে রইল, কেউ বেশ খানিকক্ষণ কোনো কথা বলল। শেষ পর্যন্ত শু বলল, লন যেটা বলেছে সেটা স্রেফ পাগলামি, এর ভিতরে কোনো যুক্তি নেই এবং কাজটা হবে পরিষ্কার গোয়ার্তুমি। আমাদের ভিতরে যে–কেউ মারা পড়তে পারে এবং আমি নিশ্চিত কাজটা বেআইনি। একে অপরের জীবনের ঝুঁকি নেয়ার জন্যে আমাদের জবাবদিহি করতে হবে। কিন্তু আমাকে স্বীকার করতেই হবে আমি তবু এটা করতে চাই। আমি সবকিছু ছেড়েছুঁড়ে শুধুমাত্র একটা প্রাচীন অস্ত্র হাতে নিয়ে ওই পাহাড়ের পাদদেশে যেতে চাই।
রিফা ভয় পাওয়া চোখে শুয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি যেতে চাও?
হ্যাঁ।
যদি– যদি কোনো বিপদ হয়?
সেটা দেখার জন্যেই যাওয়া।
রিফা কী একটা বলতে চাইছিল, তাকে বাধা দিয়ে ক্রিক বলল, আমিও যেতে চাই।
রিফা ঘুরে তাকাল ক্রিকের দিকে, তুমিও যেতে চাও?
হ্যাঁ। ক্রিক একটু হাসার মতো ভঙ্গি করে বলল, কাজটা সম্পূর্ণ বেআইনি কিন্তু আমি তবু করে দেখতে চাই। এই যুগে আমাদের জীবন খুব বেশি ছকে বাঁধা–একটা বড়ধরনের বৈচিত্র্য মনে হয় মন্দ হবে না।
স্না পানিতে তার পা নাড়িয়ে বলল, আমিও করে দেখতে চাই। আর তোমরা এটাকে যেটুকু বিপজ্জনক বা বেআইনি ভাবছ এটা সেরকম বিপজ্জনক বা বেআইনি নয়। আমরা যে এটা করছি সেটা কেউ না জানলেই হল।
লন মাথা নাড়ল, তা ঠিক।
আর আমরা সবাই যদি কাছাকাছি থাকি তাহলে কোনো বড় ধরনের ঝামেলা হওয়ার কথা নয়। আমাদের হয়তো কষ্ট হবে, শারীরিক পরিশ্রম হবে কিন্তু বিপদ হবে না।
লন মাথা নাড়ল, স্না ঠিকই বলেছে।
শু এবার ঘুরে তাকাল রিফার দিকে, রিফা, তুমি ছাড়া আর সবাই রাজি।
রিফা শুকনো মুখে বলল, আমার এখনো ভয় ভয় করছে। কিন্তু তোমরা সবাই যদি রাজি থাক তাহলে আমিও যাব। অবশ্যি যাব।
সাথে সাথে দলের অন্য সবাই একসাথে আনন্দধ্বনি করে ওঠে।
.
পুরো দলটি ঘণ্টাখানেকের মাঝে প্রস্তুত হয়ে নেয়। নিরাপত্তার আধুনিক সকল সরঞ্জাম রেখে দিয়ে তারা প্রাচীনকালের মানুষের মতো অল্প কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে রওনা হয়। তাদের পিঠের ব্যাকপেকে থাকে–খাবর, স্লিপিং ব্যাগ আর কিছু কাপড়। তাদের হাতে থাকে প্রাচীন অস্ত্র, একটি কুড়াল, কয়েকটি ছোরা এবং কিছু বড় লাঠি। ছোট দলটি হ্রদের তীর ধরে হেঁটে হেঁটে উপরে উঠে যেতে থাকে। প্রথমে তাদের বুকের মাঝে জমে থাকে এক ধরনের আতঙ্ক, খুব ধীরে ধীরে তাদের সেই আতঙ্ক সরে গিয়ে সেখানে এক ধরনের আত্মবিশ্বাস এসে ভর করে। তারা হ্রদটিকে ঘিরে গভীর অরণ্যে প্রবেশ করে, লতাগুল কেটে কেটে অরণ্যের গভীরে যেতে থাকে। যখন রাতের অন্ধকার নেমে আসে, একটা খোলা জায়গায় শুকনো গাছের ডাল লতা পাতা জড়ো করে সেখানে আগ্রুন ধরিয়ে দেয়। বিশাল। অগ্নিকুণ্ডের দিকে তাকিয়ে সবাই গোল হয়ে বসে থাকে, ব্যাকপেক থেকে খাবার বের করে আগুনে ঝলসে ঝলসে খেতে থাকে। তাদের চেহারায় এক ধরনের ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট হয়ে আসে কিন্তু তাদের চোখ উত্তেজনায় জ্বলজ্বল করতে থাকে। তারা কথা বলে নিচু স্বরে এবং ক্রমাগত চকিত দৃষ্টিতে এদিক–সেদিক তাকাতে থাকে। গভীর জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে নিশাচর পশুর ডাক শুনতে শুনতে তারা নিজেদের বুকের ভিতরে রহস্য এবং আতঙ্কের এক বিচিত্র অনুভূতি অনুভব করতে থাকে। রাত্রিবেলা তারা পালা করে ঘুমায় এবং কেউই সত্যিকার অর্থে ঘুমাতে পারে না এবং একটু পরে পরে তারা চমকে চমকে ঘুম থেকে জেগে ওঠে।