পৃথিবীর মানুষটি শব্দ করে হাসল, বলল, না ত্রাতিনা ভয় নেই। সেরকম কিছু হয় নি। পৃথিবী বিষাক্ত কেমিক্যালে ঢেকে যায় নি, প্রকৃতি তার সমস্ত সৌন্দর্য নিয়ে এখানে বিকশিত হয়ে আছে। এখানে পরিষ্কার নীল আকাশ, সাদা মেঘ, ঘন সবুজ বনাঞ্চল!
সত্যি?
হ্যা সত্যি। আর রবোটকে নিয়েও তোমার ভয় নেই। প্রায় দেড় হাজার বছর আগে একবার রবোট অভ্যুথান হয়েছিল কিন্তু সেটা খুব সহজে সামলে নেয়া গেছে। এখন পৃথিবীতে মানুষ আর রবোটদের খুব শান্তিপূর্ণ অবস্থান রয়েছে।
ত্রাতিনা খুশিতে হেসে ফেলললল, পৃথিবীতে তাহলে দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণা নেই।
না, না, তা নয়। মানুষ থাকলেই তাদের দুঃখ কষ্ট থাকে। তাদের আনন্দ বেদনা থাকে। কিন্তু বলতে পার বড় ধরনের অবিচার নেই, শোষণ নেই, যুদ্ধ–বিগ্রহ নেই। অনিয়ন্ত্রিত রোগ শোক নেই।
চমৎকার! আমি আর অপেক্ষা করতে পারছি না।
পৃথিবী থেকে মানুষটি কোমল গলায় বলল, আমরাও অপেক্ষা করতে পারছি না।
ত্রাতিনার সাথে ধীরে ধীরে পৃথিবীর এই মানুষটির এক ধরনের সখ্য গড়ে ওঠে। ভিডিও চ্যানেল নেই বলে একজন আরেকজনকে দেখতে পাচ্ছে না, শুধুমাত্র কণ্ঠস্বর দিয়েই তাদের পরিচয়। শুধু তাই নয়, কণ্ঠস্বরটি ভাষা পরিবর্তনের মডিউলের ভিতর দিয়ে গিয়েছে বলে একে অন্যের সত্যিকারের কণ্ঠস্বরটি শুনতে পাচ্ছে না। কিন্তু তবু তাতে কোনো অসুবিধে হল।, সম্ভবত শুধুমাত্র মানুষই মনে হয় সবরকম ব্যবধান ছিন্ন করে একে অন্যকে এত সহজে স্পর্শ করতে পারে।
ত্রাতিনা ধীরে ধীরে পৃথিবীর আরো কাছে এগিয়ে আসে। পৃথিবীর মানুষটির কাছে সে নানা ধরনের খবর পেতে থাকে। পৃথিবীর জ্ঞান–বিজ্ঞানের উন্নতি কোন কোন দিকে হয়েছে। জানার চেষ্টা করে যদিও তার বেশিরভাগ সে বুঝতে পারে না। তবে মানুষের জীবনযাত্রার যে একটা খুব বড় পরিবর্তন হয়েছে সেটা বুঝতে তার কোনো অসুবিধে হয় না। সে যখন পৃথিবীতে বেঁচেছিল তখন মানুষকে নানা ধরনের যানবাহনে ক্রমাগত এক জায়গা থেকে অন্য
জায়গায় যেতে হত কিন্তু এখন আর যেতে হয় না। মানুষ ক্রমাগত স্থান পরিবর্তনের প্রয়োজনটুকু মিটিয়ে নিয়েছে, এখন মানুষ আর ‘স্থান’–এর কাছে যায় না, স্থান মানুষের কাছে আসে। যদিও ব্যাপারটি কেমন করে ঘটে ত্রাতিনা ঠিক বুঝতে পারে নি কিন্তু এই জিনিসটি পৃথিবীর পরিবেশ এক ধাপে অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে গেছে।
পৃথিবীর আরো কাছাকাছি এগিয়ে আসার পর ভিডিও চ্যানেলটি কাজ করতে শুরু করে। প্রথমে আবছা আলো–আঁধারিতে বিচ্ছিন্ন কিছু ছবি, এবং এক সময় সেটা স্পষ্ট হতে শুরু করে। ত্রাতিনা পৃথিবীর নীল আকাশ, উত্তাল সমুদ্র এবং ঘন সবুজ বনাঞ্চল দেখতে পায়। নীল পাহাড়ের সারি এবং শুভ্র তুষার দেখতে পায়, আকাশে মেঘের সারি দেখতে পায়। পরিচিত পৃথিবীকে দেখে ত্রাতিনা তার বুকের মাঝে এক বিচিত্র ধরনের আবেগ অনুভব করতে থাকে। মানুষ যে তার গ্রহটির জন্যে কতটুকু ব্যাকুল হতে পারে সে আগে কখনোই সেটা অনুভব করে নি।
পরের কয়েকদিন ত্রাতিনাকে পৃথিবীর বর্তমান অবস্থার সাথে পরিচয় করানো শুরু হয়। কিন্তু কোনো একটি বিচিত্র কারণে তাকে পৃথিবীর কোনো মানুষকে দেখানো হয় না। এতদিন মহাকাশযান থেকে যে মানুষটির সাথে কথা বলেছে, যে মধ্যবয়স্ক একজন হৃদয়বান যুবা পুরুষ এবং যার নাম ক্রিটন তাকেও সে এক নজর দেখতে পায় না। কয়েকদিন পর ত্রাতিনা ব্যাপারটা নিয়ে কৌতূহল প্রকাশ করে। ক্রিটন দীর্ঘ সময় চুপ করে থেকে বলল, তুমি দুই হাজার বছর পর পৃথিবীতে ফিরে আসছ, এর মাঝে মানুষের জীবনযাত্রার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। মানুষের জীবনযাত্রার যদি পরিবর্তন হয় তার চেহারাতেও পরিবর্তন হয়। সেই পরিবর্তনটুকু তুমি কীভাবে নেবে বুঝতে পারছি না বলে আমরা একটু সময় নিচ্ছি।
ত্রাতিনা হালকা গলায় বলল, তোমরা পৃথিবীর মানুষেরা কি সবাই সবুজ রঙের চুল আর বেগুনি রঙের চামড়া করে ফেলেছ? কপালে আরেকটা চোখ।
ক্রিটন নরম গলায় হেসে উঠে বলল, বলতে পার অনেকটা সেরকমই।
তোমরা বারবার জীবনযাত্রার পরিবর্তন কথাটি ব্যবহার করছ। সেটা বলতে কী বুঝাতে চাইছ বলবে?
ক্রিটন একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, যেমন ধরা যাক একটি আদিম জৈবিক অনুভূতি, খাওয়া। ক্ষুধার্ত মানুষের খেতে ভালো লাগে, কিন্তু ভালো লাগার অনুভূতিটা আসে মস্তিষ্ক থেকে। মানুষের মস্তিষ্কের কোন জায়গা থেকে সেই অনুভূতিটা আসে যদি আমরা জেনে ফেলি তাহলে আমরা ঠিক সেখানে কিছু একটা করে মানুষকে ভালো খাওয়ার অনুভূতি দিতে পারি।
তোমরা এখন তাই কর?
হ্যাঁ। আমরা মানুষের ইন্দ্রিয়কে জয় করেছি। এখন মুখ দিয়ে খেতে হয় না, কান দিয়ে শুনতে হয় না, চোখ দিয়ে দেখতে হয় না, হাত দিয়ে স্পর্শ করতে হয় না। এমনকি জৈবিক সম্পর্ক করার জন্যেও পুরুষ–রমণীকে একত্রিত হতে হয় না। সমস্ত অনুভূতিগুলো সোজাসুজি মস্তিষ্কে দেয়া হয়।
ত্রাতিনা কেমন যেন শিউরে উঠল, বলল, কী বলছ তুমি?
ঠিকই বলছি। তুমি দুই হাজার বছর পরে আসছ বলে তোমার কাছে বিচিত্র মনে হচ্ছে। আসলে এটা মোটেও বিচিত্র নয়। এটাই স্বাভাবিক। এটাই সত্যিকারের অনুভূতি। যেহেতু আমাদের ইন্দ্রিয়কে ব্যবহার করতে হয় না, ইন্দ্রিয়ের অনুভূতি সরাসরি মস্তিষ্কে দেয়া হয়, আমাদের চলাফেরার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। আমরা এক জায়গায় বসে থাকতে পারি। একজনের সাথে অন্যজন কথা বলার জন্যে তার ছবিটি সরাসরি মস্তিষ্কে নিয়ে আসা হয়। বেড়াতে যাওয়ার জন্যে বাইরে যেতে হয় না, বাইরের দৃশ্যের অনুভূতি সরাসরি মস্তিষ্কে নিয়ে আসা হয়। শুধু তাই নয়, তোমরা যেটা কখনো পার নি, আমরা একজনের অনুভূতি অন্যেরা অনুভব করতে পারি। মহামানবেরা কেমন করে চিন্তা করে আমরা অনুভব করতে পারি।