তারপর থেকে সে একা। বিধ্বস্ত একটি মহাকাশযানে বিশাল মহাকাশে হারিয়ে যাওয়া একটি তরুণী। মহাকাশযানের পঙ্গু কম্পিউটার পৃথিবীতে ফিরে যাবার চেষ্টা করে করে বারবার ব্যর্থ হয়েছে। মহাকাশযানের জ্বালানি ফুরিয়ে আসছে এবং একসময় ত্রাতিনা বুঝতে পারে সে আর কখনো পৃথিবীতে ফিরে যেতে পারবে না। গম্ভীর হতাশায় ডুবে গিয়ে সে তখন পুরো মহাকাশযানটিকে ধ্বংস করে দেবার প্রস্তুতি নিয়েছে। স্বেচ্ছা–ধ্বংস মডিউলটি চালু করেছে। সার্কিটটি পরীক্ষা করেছে, বিস্ফোরকগুলো সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছে, তারপর পুরো সিস্টেমটি অন করেছে। তখন কন্ট্রোল প্যানেলে বড় একটি সুইচে লাল আলো জ্বলতে এবং নিভতে শুরু করেছে, এই সুইচটা একবার স্পর্শ করলেই পুরো মহাকাশযানটি প্রচণ্ড বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়ে যাবে।
ঠিক যখন ত্রাতিনা মহাকাশযানটিকে নিয়ে ধ্বংস হয়ে যাবার প্রস্তুতি নিল তখন মূল কম্পিউটারের এন্টেনায় একটা ক্ষীণ সিগনাল ধরা পড়ল, বোঝা যায় না এ রকম ক্ষীণ। প্রথম ভেবেছিল বুঝি যান্ত্রিক গোলযোগ বা মহাজাগতিক রশ্মি, কিন্তু দেখা গেল সেটি একটি মহাকাশ স্টেশনের নিয়মিত সিগনাল। সেই মহাকাশযানের সিগনালকে অনুসরণ করে ত্রাতিনা পৃথিবীর ঠিকানা খুঁজে পেয়েছে। বিস্ময়াভিভূত হয়ে আবিষ্কার করেছে তার মহাকাশযানে পৃথিবীতে ফিরে যাবার মতো জ্বালানি রয়ে গেছে। সেই থেকে তারা পৃথিবীর দিকে ফিরে আসতে শুরু করেছে। মহাকাশযানের অর্ধবিধ্বস্ত কম্পিউটারটির জন্যে কাজটি সহজ নয়, যে হিসাবটি এক মাইক্রো সেকেন্ডে হয়ে যাবার কথা, সেটি শেষ হতে কখনো কখনো কয়েক সেকেন্ড লেগে যায়। তবুও মহাকাশযানটি তার নির্দিষ্ট কক্ষপথে অবস্থান নিতে পেরেছে, শেষ পর্যন্ত সেটি সৌরজগতের দিকে ছুটে যেতে শুরু করেছে। ত্রাতিনা মহাকাশযানের কম্পন থেকে অনুভব করতে পারে তার গতিবেগ বেড়ে যেতে শুরু করেছে। তাকে আর বিশাল মহাকাশে হারিয়ে যেতে হবে না, নিজের পৃথিবীতে নিজের মানুষের কাছে ফিরে যেতে পারবে।
ত্রাতিনা ধীরে ধীরে প্রস্তুতি নিয়েছে। মহাকাশযানের স্বচ্ছ মসৃণ ক্রোমিয়াম দেয়ালে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখেছে, কালো চোখ সুগঠিত বুক কোমল দেহকে পরপুরুষের চোখে যাচাই করেছে। মানুষের ভাষায় নিজের সাথে কথা বলেছে, মানুষের অনুভূতির সাথে নিজেকে পরিচিত করেছে। কন্ট্রোলঘরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিশাল মনিটরে পৃথিবীর মানুষের কণ্ঠস্বর শোনার জন্যে অপেক্ষা করেছে। কিন্তু কোনো একটি অজ্ঞাত কারণে, বলা যেতে পারে এক ধরনের বিচিত্র কুসংস্কারের কারণে মহাকাশযান ধ্বংস করার সুইচটিকে অচল করে দেয় নি। সেই সুইচটির মাঝে লাল আলো জলছে এবং নিভছে, প্রতি মুহূর্তে তাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে, একটিবার স্পর্শ করলেই মহাকাশযানটি তাকে নিয়ে ধ্বংস হয়ে যাবে। কে জানে হয়তো মৃত্যুকে এত কাছাকাছি রেখে বেঁচে থাকলেই জীবনকে বোঝা যায়।
পৃথিবী থেকে যখন প্রথম সিগনালটি এসেছে, ত্রাতিনা তখন বিশ্রাম নেবার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। মনিটরে একটা শব্দতরঙ্গ দেখে বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠে, মাইক্রোফোনে মুখ লাগিয়ে সে কথা বলে নিজের মহাকাশযানের পরিচয় দেয়। স্পিকারে খানিকক্ষণ স্থির বিদ্যুতের কর্কশ শব্দ শোনা যায়, তারপর হঠাৎ পরিষ্কার মানুষের গলার কণ্ঠস্বর শোনা গেল। কেউ একজন কোমল গলায় তাকে অভিবাদন জানিয়ে বলল, পৃথিবীর মানুষ হারিয়ে যাওয়া মহাকাশচারী ত্রাতিনাকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে।
ত্রাতিনা কয়েক মুহূর্ত কোনো কথা বলতে পারে না। তার সমস্ত শরীরে এক ধরনের শিহরন বয়ে যায়। কোনোমতে নিজেকে শান্ত করে বলল, ধন্যবাদ। অনেক ধন্যবাদ।
তোমার ভিডিও চ্যানেলটি কোথায়? আমরা তোমাকে দেখতে পাচ্ছি না।
ওয়ার্মহোলে আমাদের যে দুর্ঘটনাটি ঘটেছিল সেখানে নষ্ট হয়ে গেছে। ইমার্জেন্সি একটা ভিডিও চ্যানেল আছে কিন্তু তার ট্রান্সমিটারটি খুব দুর্বল, আরো কাছে না এলে সেটা কাজ করবে না। আমি অবশ্যি চালু রেখেছি।
চমৎকার। আমরা তোমাকে দেখার জন্যে খুব উদগ্রীব। দুই হাজার বছর আগের রক্তমাংসের মানুষ সত্যি সত্যি দেখতে পাওয়া খুব সৌভাগ্যের ব্যাপার।
দুই হাজার? ত্রাতিনা চিৎকার করে বলল, দুই হাজার বছর? সে কী করে সম্ভব? আমি বড়জোর দশ থেকে বিশ বছর মহাকাশে আছি। আপেক্ষিক বেগের কারণে হয়তো আরো এক শ দুই শ বছর যোগ হতে পারে– দুই হাজার বছর কেমন করে হল?
স্পিকারের কণ্ঠস্বর বেশ কিছুক্ষণ নীরব থাকে। তারপর আবার শোনা যায়, মানুষটি দ্বিধান্বিত গলায় বলল, আমাদের কাছে সব তথ্য নেই কিন্তু তোমার মহাকাশযানের মূল কম্পিউটারের পাঠানো তথ্য থেকে মনে হচ্ছে ওয়ার্মহোলে তোমরা যখন মহাবিপর্যয়ে পড়েছিলে তখন তোমাদের এক দুইবার হাইপার ডাইভ দিতে হয়েছে, দুই হাজার বছরের বেশিরভাগ তখনই পার হয়ে গেছে।
ত্রাতিনা নিশ্বাস ফেলে বলল, কী আশ্চর্য! দুই হাজার বছর। পৃথিবীতে নিশ্চয়ই অনেক পরিবর্তন হয়েছে। তাই না?
হ্যাঁ হয়েছে।
ভালো পরিবর্তন না খারাপ পরিবর্তন?
ভালো আর খারাপ তো খুব আপেক্ষিক কথা। একজনের কাছে যেটা ভালো মনে হয় অন্যের কাছে সেটা খারাপ লাগতে পারে।
তা ঠিক। কিন্তু তবুও তো কিছু কিছু সত্যিকারের ভালো খারাপ হতে পারে। যেমন, যদি সমস্ত পৃথিবী বিষাক্ত কেমিক্যালে ঢেকে থাকে আমি বলব সেটা খারাপ। যদি পৃথিবীতে মানুষের বদলে রবোটেরা তার জায়গা দখল করে নিত সেটা হত খারাপ।