ল্যাবরেটরি ঘরে সবাই পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকে, তাদের কারো বিশ্বাস হচ্ছে না রিশ স্পেস টাইমের বিশাল এক জগতের কোথাও চিরদিনের জন্যে হারিয়ে গেছে।
.
বিশ শক্ত একটা মেঝেতে আছাড় খেয়ে পড়ার সাথে সাথে সব শব্দ যেন মন্ত্রের মতো থেমে গেল। শক্তিশালী পাওয়ার সাপ্লাইয়ের গুঞ্জন ছিল, ইমার্জেন্সি সঙ্কেতের তীক্ষ্ণ শব্দ ছিল, ভয় পাওয়া মানুষের আর্তনাদ ছিল, হঠাৎ করে কোথাও কিছু নেই। চারদিকে সুনসান নীরবতা। একটু আগে শরীরে যে প্রচণ্ড যন্ত্রণা ছিল সেই যন্ত্রণাও হঠাৎ করে চলে গেছে, বুকের মাঝে হৃৎপিণ্ডটি শুধু এখনো প্রচণ্ড শব্দ করে ধকধক করে যাচ্ছে।
রিশ উঠে বসতেই তার পায়ে কী একটা লাগল, তুলে দেখে একটা ছোট স্ক্রু–ড্রাইভার, একটু আগে সেটাকে টানেলের মাঝে দিয়ে ছুঁড়ে দেয়া হয়েছিল। রিশ মাথা তুলে তাকাল। স্পেস টাইম কন্টিনিউয়ামের টানেল দিয়ে সে এখানে এসে পড়েছে, কিন্তু টানেলটির মুখটা সে দেখতে পাচ্ছে না, এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুজে গিয়েছে।
রিশ উঠে দাঁড়িয়ে মাথা তুলে তাকাল। জায়গাটা আবছা অন্ধকার। একটু আগে ল্যাবরেটরির তীব্র চোখ–ধাঁধানো আলো থেকে হঠাৎ করে এই আবছা অন্ধকারে এসে প্রথমে সে ভালো করে কিছু দেখতে পায় না। একটু পর আস্তে আস্তে তার চোখ সয়ে এল, মস্ত বড় একটা হলঘরের মতো জায়গা, দেয়ালের কাছাকাছি নানারকম যন্ত্রপাতি সাজানো, মাথার। উপরে একটা হলুদ আলো মিটমিট করে জ্বলছে। বিশ ভালো করে তাকাল, জায়গাটা কেমন জানি পরিচিত মনে হচ্ছে তবু ভালো করে চিনতে পারছে না। রিশ ভালো করে তাকাল এবং আবছা হলুদ ভূতুড়ে আলোতে সে জায়গাটি চিনতে পারল, এটি তার ল্যাবরেটরি ঘর। দীর্ঘদিনের অব্যবহারে এ রকম ভূতুড়ে একটা রূপ নিয়েছে। রিশ এক ধরনের আতঙ্ক অনুভব করে, সে হঠাৎ করে ভবিষ্যতে চলে এসেছে। কতদিন ভবিষ্যতে এসেছে সে?
রিশ উঠে দাঁড়াল, ল্যাবরেটরির পিছনে একটা ছোট দরজা ছিল, এখনো সেই দরজাটা আছে কি না কে জানে। কিছু বাক্স সরিয়ে রিশ দরজাটা আবিষ্কার করে, হাতলে চাপ দিতেই সেটা খুট করে খুলে গেল। দরজাটা খুলে বাইরে আসতেই শীতল বাতাসের একটা ঝাপটা অনুভব করে। এখন শীতকাল। এক মুহূর্ত আগে সে গ্রীষ্মের এক রাতে ছিল, এখন সেটাকে কত পিছনে ফেলে এসেছে কে জানে।
রিশ হেঁটে হেঁটে বের হয়ে আসে। ল্যাবরেটরিটা একটা ভূতুড়ে বাড়ির মতো দেখাচ্ছে, দীর্ঘদিন থেকে সেটা নিশ্চয়ই অব্যবহৃত হয়ে আছে। কতদিন হবে? এক বছর? দুই বছর? দশ বছর? নাকি এক শ বছর? হঠাৎ করে এক ধরনের আতঙ্ক অনুভব করে রিশ। কতদিন পার হয়েছে এর মাঝে? বীপার কথা মনে পড়ে হঠাৎ করে, কোথায় আছে এখন বীপা? কেমন আছে বীপা?
.
বীপা হতচকিত হয়ে তাকিয়ে রইল রিশের দিকে, তারপর কষ্ট করে নিজেকে শান্ত করে বলল, তুমি?
হা বীপা। আমি।
এতদিন পরে?
এতদিন পরে নয় বীপা। এই একটু আগে আমি তোমাকে অবজারভেশন টাওয়ারে ছেড়ে এসেছি। এক ঘণ্টাও হয় নি।
বীপা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, না রিশ। এক ঘণ্টা নয়–প্রায় এক যুগ হয়ে গেছে।
এক যুগ? রিশ আর্তনাদ করে বলল, এক যুগ?
এক যুগ থেকেও বেশি। আমাকে দেখে তুমি বুঝতে পারছ না?
না। রিশ মাথা নাড়ল, তোমার চেহারার সেই ছেলেমানুষি ভাবটি আর নেই, কিন্তু তোমাকে দেখে বুঝতে পারছি না। তোমাকে দেখে ঠিক সেরকমই লাগছে।
কিন্তু আমি আর সেরকম নেই। রিশ আমি আর আগের বীপা নেই।
রিশের বুকের মাঝে হঠাৎ করে কেঁপে ওঠে, কেন বীপা, কী হয়েছে?
এক যুগ অনেক সময়। আমি তোমার জন্যে অনেকদিন অপেক্ষা করেছি। অনেকদিন। তুমি আস নি।
রিশ কাতর গলায় বলল, এই তো এসেছি।
অনেক দেরি করে এসেছ।
রিশ প্রায় আর্তনাদ করে বলল, তুমি… তুমি আর কাউকে বিয়ে করেছ বীপা?
বীপার মুখে হঠাৎ একটা বেদনার ছায়া পড়ল। সে মাথা নিচু করে বলল, আমি দুঃখিত রিশ, আমি খুব দুঃখিত। আমি খুব সাধারণ মেয়ে। আমি নিঃসঙ্গতা সইতে পারি না। আমি ভেবেছিলাম তুমি আর আসবে না। আমি ভেবেছি তুমি চিরদিনের জন্যে হারিয়ে গেছ। বার বছর অনেক সময়। এই সময়ে সব পাল্টে যায়। আমি খুব সাধারণ মেয়ে, খুব সাধারণ একটা ছেলের সাথে আমি ঘর বেঁধেছি। আমাদের একটা ছেলে আছে। মনে হয় সেও খুব সাধারণ একটা ছেলে হয়ে বড় হবে। জান রিশ, সেটা কিন্তু আশীর্বাদের মতো।
রিশ খানিকক্ষণ দেয়াল ধরে শূন্যদৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর বলল, আমি যাই বীপা।
যাবে?
হ্যাঁ।
বীপা জিজ্ঞেস করতে চাইল, তুমি কোথায় যাবে রিশ? কিন্তু সে জিজ্ঞেস করল না।
বার বছর পর কাউকে আর এই কথা জিজ্ঞেস করা যায় না। তাদের একজনের ওপর আরেকজনের আর কোনো অধিকার নেই।
ত্রাতিনার স্বগ্রহে প্রত্যাবর্তন
ত্রাতিনা মহাকাশযানের গোল জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়েছিল। বাইরে গাঢ় অন্ধকার মহাকাশ, কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেই বুকের ভিতরে এক ধরনের নিঃসঙ্গতা ভর করে। ত্রাতিনা বহুকাল থেকে নিঃসঙ্গ, নিঃসঙ্গতাতে সে অভ্যস্ত হয়ে গেছে, স্কিনিস্কির নবম সিম্ফোনি শুনতে শুনতে সে দীর্ঘসময় জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকতে পারে।
আজকেও সে বাইরে তাকিয়েছিল, ঘুরেফিরে বারবার তার সহঅভিযাত্রীদের কথা মনে পড়ছে। তাদের দলপতি শ্রুরা, ইঞ্জিনিয়ার কিরি, তাদের জীববিজ্ঞানী ইলিনা নেভিগেটর থুল– আরো কতজন। যখন ওয়ার্মহোলের প্রবল আকর্ষণে মহাকাশযানটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ঘুরপাক খেতে খেতে অতল গহ্বরে হারিয়ে যেতে শুরু করেছিল, কী পাগলের মতোই না তারা মহাকাশযানটিকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিল। শেষ রক্ষা করতে পারে নি, প্রচণ্ড বিস্ফোরণে একটা অংশ ছিটকে বের হয়ে গিয়েছিল, আর ঠিক তখন মহাকাশযানের মূল কম্পিউটার মহাকাশযানের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কোনোভাবে প্রবল আকর্ষণের কেন্দ্র থেকে বের হয়ে এসেছিল। ত্রাতিনা ছিটকে পড়েছিল কন্ট্রোল প্যানেলে, সেখান থেকে মেঝেতে। যখন জ্ঞান হয়েছে নিজেকে আবিষ্কার করেছে একটি ধ্বংস্তস্তুপে। ইমার্জেন্সি আলো নিয়ে মহাকাশযানে ঘুরে ঘুরে সে তার সহঅভিযাত্রীদের মৃতদেহ আবিষ্কার করেছে। বিশাল একটা অংশ উড়ে বের হয়ে গেছে, সেখানে যারা ছিল তাদেরকে আর কখনো খুঁজে পাওয়া যায় নি, অন্যদের মৃতদেহ সে গভীর ভালবাসায় স্টেনলেস স্টিলের ক্যাপসুলে ভরে মহাকাশে ভাসিয়ে দিয়েছে।