মেয়েটা এবারে স্ক্রু –ড্রাইভারটা হাতে নিয়ে গায়ের জোরে ছুঁড়ে দিল। সত্যি সত্যি সেটা আয়নার মতো পরদাটির মাঝে ঢুকে গেল এবং হঠাৎ করে শাৎ করে শুষে নেবার মতো একটা শব্দ হল এবং পুরো স্কু–ড্রাইভারটাকে যেন অদৃশ্য কিছু একটা টেনে ভিতরে নিয়ে গেল। ব্যাপারটা দেখে ল্যাবরেটরি ঘরে যারা দাঁড়িয়েছিল সবাই একই সাথে বিস্ময়ের মতো একটা শব্দ করল। রিশ উত্তেজিত গলায় বলল, দেখেছ, এর মাঝে শক্তির পার্থক্যের একটা ব্যাপার আছে। সহজে জিনিসটা ভিতরে যেতে চায় না। কিন্তু একবার ঢুকে গেলে কিছু একটা টেনে নিয়ে যায়–ঠিক যেরকম রিসানের সূত্রে বলা হয়েছিল।
কমবয়সী একজন তরুণ এক পা এগিয়ে এসে বলল, এর মাঝে কি কোনো বিপদ আছে?
কী রকম বিপদ?
যেমন মনে কর এই টানেল দিয়ে সবকিছু টেনে বের করে নিয়ে গেল, অন্য কোথাও। নিয়ন্ত্রণের বাইরে অন্য কিছু ঘটে গেল, পুরো জগৎ বিশ্বব্রহ্মাণ্ড অদৃশ্য হয়ে গেল।
রিশ হেসে ফেলল, বলল, না। এই টানেলটা তৈরি করা হয়েছে ল্যাবরেটরির শক্তি দিয়ে। এই টানেল দিয়ে ছোটখাটো জিনিস এক শ–দু শ কিলোগ্রাম এদিক–সেদিক করা। যাবে, তার বেশি কিছু নয়।
তার মানে এই পুরো জগতকে শুষে নেবার কোনো ভয় নেই?
না। শক্তির নিত্যতার সূত্র যদি সত্যি হয় তার কোনো ভয় নেই।
কমবয়সী মেয়েটা এগিয়ে এসে বলল, আমার স্কু–ড্রাইভার কি টানেলের অন্য মাথা দিয়ে এতক্ষণে বের হয়ে গেছে?
রিশ হেসে বলল, আমার তাই ধারণা।
কেউ কি সেটা দেখতে পেয়েছে?
কেমন করে বলি। হয়তো দেখেছে। হয়তো দেখে নি।
মেয়েটা আরেকটা কী কথা বলতে যাচ্ছিল, মধ্যবয়স্ক টেকনিশিয়ান বাধা দিয়ে বলল, আমাদের হাতে বেশি সময় নেই। পাওয়ার সাপ্লাই যেটুকু শক্তি দেবার কথা তার থেকে অনেক বেশি টেনে নেয়া হয়েছে। পুরোটা ওভারলোডেড হয়ে আছে। আর কিছু যদি দেখার না থাকে তাহলে বন্ধ করে দেয়া উচিত।
রিশ বলল, এক সেকেন্ড, আমি একটা জিনিস পরীক্ষা করে নি।
টেকনিশিয়ান জিজ্ঞেস করল, কী পরীক্ষা করবে?
টানেলটার উপরে যে শক্তির স্তরটা আছে সেটা কতটুকু একটু পরীক্ষা করে দেখি।
রিশ আশপাশে তাকিয়ে একটা বড় রেঞ্চ হাতে নিয়ে এগিয়ে এল, পরদাটার উপরে সেটা দিয়ে স্পর্শ করতেই তরল পদার্থে যেরকম একটা ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে সেভাবে ঢেউ ছড়িয়ে পড়ল। রিশ রেঞ্চটা দিয়ে আবার আলতোভাবে আঘাত করল, তখন আরেকটু বড় তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ল। রিশ এবারে রেঞ্চটা হাতে নিয়ে বেশ জোরে মসৃণ আয়নার মতো দেখতে অংশটুকুর উপরে আঘাত করতেই সেটা ফুটো করে রেঞ্চটা ভিতরে ঢুকে যায় এবং শাৎ করে একটা শব্দ হয়ে পুরো রেঞ্চটাকে অদৃশ্য কিছু একটা যেন টেনে ভিতরে নিয়ে নেয়। এবং কিছু বোঝার আগেই বিশের হাতটাও কব্জি পর্যন্ত ভিতরে ঢুকে গেল। রিশ তার হাতে এক ধরনের তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা অনুভব করে এবং একটা আর্ত চিৎকার করে সে তার হাতটা টেনে। বের করতে গিয়ে আবিষ্কার করে তার হাতটাকে সে টেনে বের করতে পারছে না। তার হাতটা কোথায় জানি আটকে গেছে। শুধু আটকে যায় নি, অদৃশ্য একটা জিনিস তার হাতটাকে টেনে নেয়ার চেষ্টা করছে।
আশপাশে যারা দাঁড়িয়েছিল তারা সবাই ভাবলছি রিশ টেনে তার হাতটাকে বের করে আনবে এবং যখন দেখল সে বের করে আনছে না তখন হঠাৎ করে সবাই বুঝতে পারল সে তার হাতটাকে বের করতে পারছে না। সবার মুখে একটা আতঙ্কের ছায়া পড়ল এবং সবার আগে টেকনিশিয়ান ছুটে গিয়ে তার হাতটা ধরে টেনে বের করার চেষ্টা করল। রিশ যন্ত্রণায় চিৎকার করে বলল, পারবে না, বের করতে পারবে না।
টেকনিশিয়ান ফ্যাকাশে মুখে বলল, কেন পারব না?
টানেলের অন্য পাশে নিশ্চয়ই ভবিষ্যৎ। আমার হাতটা নিশ্চয়ই ভবিষ্যতে চলে গেছে, ভবিষ্যৎ থেকে কিছু অতীতে আসতে পারে না।
তাহলে?
হাতটা কেটে ফেলতে হবে।
ঘরের সবাই শিউরে উঠল। টেকনিশিয়ান আতঙ্কিত গলায় বলল, কেটে ফেলতে হবে?
হ্যাঁ। আর কোনো উপায় নেই। কেউ একজন ছুটে যাও একটা ইলেকট্রিক চাকু নিয়ে এস–ছুটে যাও।
সত্যি কেউ ছুটে যাবে কি না বুঝতে পারছিল না। একজন ছুটে ঘরের জরুরি বিপদ সঙ্কেতের লাল সুইচটা চেপে ধরল এবং সাথে সাথে একটা লাল আলো জ্বলতে জ্বলতে তীক্ষ্ণ বিপদ সঙ্কেত বাজতে শুরু করে। টেকনিশিয়ান কী করবে বুঝতে না পেরে আবার রিশকে জাপটে ধরে টেনে আনতে চেষ্টা করে, ফিনফিনে আয়নার মতো পাতলা পরদাটি হঠাৎ যেন পাথরের দেয়ালের মতো শক্ত হয়ে গেছে। বিশের মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে ওঠে এবং সে প্রচণ্ড যন্ত্রণায় চিৎকার করে ওঠে–ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও আমাকে।
টেকনিশিয়ান রিশকে ছেড়ে দিতেই সে হুমড়ি খেয়ে আরো খানিকটা ভিতরে ঢুকে গেল। সবাই আতঙ্কে নিশ্বাস বন্ধ করে দেখতে পেল কোন একটা অদৃশ্য শক্তি যেন তাকে ভিতরে টেনে নেবার চেষ্টা করছে, রিশ প্রাণপণে নিজেকে ধরে রাখার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না, একটু একটু করে সে ভিতরে ঢুকে যাচ্ছে।
কেউ একজন রক্ত শীতল করা শব্দে আর্তনাদ করে উঠল–তার মাঝে রিশ তার আরেকটা হাত ব্যবহার করে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে যায় আর হঠাৎ করে সেই হাতটাও ভিতরে ঢুকে গেল। হঠৎ করে অদৃশ্য একটা শক্তি দ্বিগুণ জোরে তাকে ভিতরে টেনে নিতে থাকে এবং সবাই দেখল সে আস্তে আস্তে ভিতরে ঢুকে যাচ্ছে, কী করবে কেউ বুঝতে পারে না, চারদিক থেকে মানুষ ছুটে আসছে এবং তার মাঝে সবাই দেখতে পায় রিশ স্বচ্ছ আয়নার মতো একটা জিনিসে ঢুকে যাচ্ছে, প্রথমে আস্তে আস্তে তারপর আরো জোরে এবং হঠাৎ কিছু বোঝার আগে প্রচণ্ড শক্তিতে কেউ যেন তাকে টেনে একটা গহ্বরে ঢুকিয়ে নিয়ে গেল। একটু আগে যেখানে রিশ দাঁড়িয়েছিল সেখানে কেউ নেই। চকচকে আয়নার মতো জিনিসটার মাঝে শুধু একটা তরঙ্গ খেলা করতে থাকে। কোথায় জানি একটা বিস্ফোরণের মতো শব্দ হল এবং হঠাৎ করে বড় বড় দুটি পাওয়ার সাপ্লাই বন্ধ হয়ে যায় এবং সাথে সাথে দপ করে চতুষ্কোণ আয়নার মতো জিনিসটা অদৃশ্য হয়ে গেল।