এটা অনেক বড় ব্যাপার বীপা, অনেক বড় ব্যাপার। রিসানের সূত্রকে প্রমাণ করা হয়েছে। প্রথমবার স্পেস টাইম কন্টিনিউয়ামে একটা টানেল তৈরি করা হয়েছে। সেই টানেল দিয়ে ভিন্ন সময়ে কিংবা ভিন্ন অবস্থানে চলে যাওয়া যাবে। চিন্তা করতে পার?
বীপ কোনো কথা বলল না
চল বীপা তোমাকে বাসায় পৌঁছে দিই।
বীপা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, তুমি যাও রিশ। আমি এখানে আরো কিছুক্ষণ থাকি। আমি নিজে নিজে বাসায় চলে যাব।
রিশ নিচু হয়ে তার হাতে হাত স্পর্শ করে এক রকম ছুটে বের হয়ে গেল। বীপা মাথা ঘুরিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। কোয়ার্টজের জানালা দিয়ে এখনো দূরে মেঘ আর পাহাড়ের সারি দেখা যাচ্ছে। কৃত্রিম জ্যোৎস্নার আলোতে এখনো সবকিছু কী অপূর্ব মায়াময় দেখাচ্ছে। বীপা অন্যমনস্কভাবে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। তার বুকের মাঝে একটা অভিমান এসে ভর করছে, কার ওপর এই অভিমান সে জানে না। ধীরে ধীরে তার চোখে পানি এসে যায়, দূরের বিস্তীর্ণ মেঘ আর নীল পাহাড়ের সারি অস্পষ্ট হয়ে আসে। বীপা সাবধানে হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে তার চোখের পানি মুছে ফেলল। রিশ একজন অসাধারণ বিজ্ঞানী আর সে খুব সাধারণ একজন মেয়ে। কে জানে, সাধারণ মেয়েদের বুঝি অসাধারণ বিজ্ঞানীদের ভালবাসতে হয় না। তাহলে বুঝি তাদের এ রকম একাকী নিঃসঙ্গ হয়ে বেঁচে থাকতে হয়।
.
রিশ দরজা খুলে ভিতরে ঢুকতেই তার দিকে কয়েকজন ছুটে এল। মধ্যবয়স্ক টেকনিশিয়ানটি উত্তেজিত গলায় বলল, শক্তিক্ষেত্রে প্রচুর চাপ পড়ছে রিশ, কতক্ষণ ধরে রাখতে পারব জানি না।
রিশ হাঁটতে হাঁটতে উত্তেজিত গলায় বলল, সেটা নিয়ে চিন্তা কোরো না। একবার যখন হয়েছে আবার হবে। টানেলটা কত বড়?
এক মিটার থেকে একটু ছোট।
এক জায়গায় আছে নাকি নড়ছে?
মোটামুটি এক জায়গাতেই আছে, শক্তির তারতম্য হলে একটু কাঁপতে থাকে। তুমি দেখলেই বুঝতে পারবে।
রিশ টেকনিশিয়ানের পিছু পিছু ল্যাবরেটরির দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে হতবাক হয়ে গেল। বিশাল ল্যাবরেটরি ঘরে ইতস্তত যন্ত্রপাতি ছড়ানো। দুপাশে বড় বড় যন্ত্রপাতির প্যানেল, শক্তিশালী পাওয়ার সাপ্লাই, বড় কম্পিউটার। দেয়ালের পাশে রাখা বড় বড় লেজারগুলো থেকে লেজাররশ্মি ছুটে যাচ্ছে। ঘরে যন্ত্রপাতির মৃদু গুঞ্জন, এক ধরনের ঝাঁজালো গন্ধ। ঘরের ঠিক মাঝখানে স্পেস টাইম কন্টিনিউয়ামের টানেলটি দাঁড়িয়ে আছে। দেখে মনে হয় কেউ বুঝি একটা চতুষ্কোণ আয়না ঝুলিয়ে রেখেছে। রিশ প্রায় ছুটে গিয়ে জিনিসটার কাছে দাঁড়াল, তার এখনো বিশ্বায় হয় না এই মহাবিশ্বে একটা টানেল তৈরি করা হয়েছে, আর সে সেই টানেলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে! টানেলের অন্য পাশে কী আছে কে জানে। হয়তো ভবিষ্যতের কোনো মূহর্ত হয়তো অন্য কোনো দেশ, মহাদেশ, অন্য কোন গ্রহ। অন্য কোনো গ্যালাক্সি। রিশের এখনো বিশ্বাস হতে চায় না। রিশ খুব কাছে থেকে দেখল, জিনিসটা খুব সূক্ষ্ম আয়নার মতো। দেখে মনে হয় হাতের ছোঁয়া লাগলেই বুঝি ঝনঝন করে ভেঙে পড়ে যাবে। কিন্তু এটি ঝনঝন করে ভেঙে পড়বে না, প্রচণ্ড শক্তি ব্যয় করে এটি দাঁড়া করানো আছে, যতক্ষণ ল্যাবরেটরি থেকে শক্তি দেয়া যাবে ততক্ষণ সেটা দাঁড়িয়ে থাকবে।
রিশ কয়েক মুহূর্ত টানেলটার দিকে তাকিয়ে বলল, দৃশ্যমান আলো যেতে পারছে না, তাই এটাকে দেখাচ্ছে চকচকে আয়নার মতো।
টেকনিশিয়ানরা জিজ্ঞেস করল, এটার অন্য দিকটা কোথায়, রিশ?
কেউ জানে না। আমরা শক্তি খুব বেশি দিতে পারছি না তাই সেটা খুব বেশি দূরে হওয়ার কথা নয়। হয়তো খুব কাছাকাছি।
আমরা কি অন্য মাথাটা দেখতে পাব?
যদি একই সময়ে হয়ে থাকে নিশ্চয়ই দেখব। কিন্তু সময়ের মাত্রায় যদি এটা অন্য কোথাও এসে থাকে তাহলে তো এখন দেখা যাবে না, যখন সেই সময় এসে হাজির হবে তখন দেখবে।
রিশের কাছাকাছি আরো কিছু মানুষ এসে ভিড় জমায়। অন্য বিজ্ঞানীরা, অন্য টেকনিশিয়ানরা, সবাই উত্তেজিত গলায় কথা বলতে থাকে। কমবয়সী একটা মেয়ে জিজ্ঞেস করল, টানেলটার অন্য মাথা কোথায় সেটা জানার কোনো উপায় নেই?
আছে। উপায় আছে। অনেক দীর্ঘ একটা হিসেব–নিকেশ করার ব্যাপার আছে। পুরোটা কীভাবে করতে হবে সেটা এখনো কেউ ভালো করে জানে না। যখন সেটা জানা যাবে তখন আগে থেকে বলে দেয়া যাবে এই টানেল দিয়ে কোথায় যাওয়া যাবে।
মেয়েটার হাতে একটা স্কু–ড্রাইভার ছিল সেটা দেখিয়ে বলল, আমি যদি এই স্কু ড্রাইভারটা এখানে ছুঁড়ে দিই তাহলে কী হবে?
রিশ হেসে বলল, এটা টানেল দিয়ে গিয়ে অন্য মাথা দিয়ে বের হয়ে যাবে।
মেয়েটা চোখ বড় বড় করে বলল, সত্যি ছুঁড়ে দিয়ে দেখব?
রিশ মাথা নেড়ে বলল, দেখ।
মেয়েটা স্কু–ড্রাইভারটা ঝকঝকে আয়নার মতো চতুষ্কোণ টানেলের মুখে ছুঁড়ে দিল। সবার মনে হল ঝনঝন করে বুঝি সেটা ভেঙে পড়বে। কিন্তু সেটা ভেঙে পড়ল না, স্কু ড্রাইভারটা একটা অদৃশ্য দেয়ালে বাধা পেয়ে যেন ফিরে এল। পানির মাঝে ঢিল ছুড়লে যেরকম একটা তরঙ্গের জন্ম হয় চতুষ্কোণ আয়নার মতো জিনিসটার মাঝে ঠিক সেরকম একটা তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ল।
রিশ মেঝে থেকে ভ্রু–ড্রাইভারটা তুলে মেয়েটার হাতে দিয়ে বলল, আরো জোরে ছুঁড়তে হবে, টানেলটার মুখে পৃষ্ঠটানের মতো একটা ব্যাপার আছে। জোরে না ছুড়লে সেটা ভেদ করে ভিতরে ঢোকার উপায় নেই।