প্রফেসর জগলুল কাঁপা হাতে গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করতেই এক ভয়ঙ্কর নৈঃশব্দ্য নেমে এল। কোথাও কোনো শব্দ নেই, শুধু তার হৃৎপিণ্ড ধকধক শব্দ করছে। এই ঘোট হৃৎপিণ্ড এত জোরে শব্দ করে কে জানত।
প্রফেসর জগলুল গাড়ির স্টিয়ারিং ধরে স্থাণুর মতো বসে রইলেন। আলাউদ্দিনকে মারতে গিয়ে তিনি জগলুল সিংগুলারিটিতে পা দিয়ে ফেলেছেন।
পৃথিবীর মানুষ আর কোনোদিন জগলুল সিংগুলারিটির কথা জানতে পারবে না!
টানেল
অবজারভেশন টাওয়ারটি খাড়া উপরে উঠে গেছে। স্বচ্ছ কোয়ার্টজে ঢাকা বৃত্তাকার ছোট ঘরটা থেকে তাকালে নিচে মেঘ এবং দূরে পাহাড়ের সারি চোখে পড়ে। এ রকম সময়ে মাইলারের একটা স্ক্রিন মহাকাশে খুলে দেয়া হয়, সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়ে সেখান থেকে এই এলাকায় একটা কৃত্রিম জ্যোৎস্নার আলো ছড়িয়ে পড়ে। সেই আলোতে চারদিকে এক ধরনের অতিপ্রাকৃতিক দৃশ্য ফুটে উঠছে। বীপা মুগ্ধ চোখে সেদিকে তাকিয়ে থেকে নরম গলায় বলল, কী সুন্দর তাই না?
রিশ তার কথার উত্তর না দিয়ে অন্যমনস্ক চোখে দূরে যেখানে তাকিয়েছিল সেখানেই তাকিয়ে রইল। বীপা আহত গলায় বলল, তুমি আমার কথা শুনছ না।
রিশ বলল, শুনছি।
তাহলে কথার উত্তর দিচ্ছ না কেন?
এই তো দিচ্ছি।
এটা কি উত্তর দেয়া হল? আমি যদি বলি ইস কী সুন্দর, তাহলে তুমিও বলবে ইস কী সুন্দর!
রিশ বীপার ছেলেমানুষি মুখের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে হেসে বলল, ঠিক আছে, এখন থেকে বলব।
সত্যি?
সত্যি।
বীপার মুখটি আনন্দে ঝলমল করে উঠল। সে রিশের হাত শক্ত করে ধরে রেখে বলল, আজ এখানে এসে আমার কী যে ভালো লাগছে।
এই হাসিখুশি মেয়েটার জন্যে রিশ তার বুকের ভিতরে এক ধরনের গভীর ভালবাসা অনুভব করে। সে তার মাথায় হাত দিয়ে সোনালি চুলগুলোকে এলোমেলো করে দিয়ে বলল, আমারও খুব ভালো লাগছে।
বীপা হাসিমুখে বলল, এই তো তুমি কথা বলা শিখে গেছ!
আমি বলেছিলাম না, সবকিছু খুব তাড়াতাড়ি শিখে নিই। এখন বিশ্বাস হল?
বীপা মাথা নাড়ে, হল।
রিশ আর বীপা হাত ধরাধরি করে বৃত্তাকার অবজারভেশন টাওয়ারটি একবার ঘুরে আসে। তাদের মতো আরো অনেকেই এসেছে। সপ্তাহে একদিন মাইলারের এই স্ক্রিনটা খুলে কৃত্রিম জ্যোৎস্না ছড়িয়ে দেয়া হয়, সেদিন এই বিচিত্র জ্যোৎস্নার মায়াময় দৃশ্য দেখার জন্যে অনেক দূর দূর থেকে এই টাওয়ারের সবাই এসো জড়ো হয়। কোয়ার্টজের জানালায় হেলান দিয়ে সবাই বাইরে তাকিয়ে আছে, তাদের মাঝে ধীরে ধীরে পা ফেলে হেঁটে যেতে যেতে বীপা বলল, আজকে আমরা সারারাত এখানে থাকব।
বিশ হাসিমুখে বলল, ঠিক আছে থাকব।
সারারাত আমরা কথা বলব।
কী নিয়ে কথা বলবে?
কত কী বলার আছে আমার। কোথায় বিয়ে হবে আমাদের। কোথায় যাব বেড়াতে। কতজন বাচ্চা হবে আমাদের। তার মাঝে কতজন হবে ছেলে, কতজন মেয়ে! তুমি কি কখনো আমাকে কথা বলার সময় দাও?
এই তো দিচ্ছি।
ছাই দিচ্ছ। তোমাকে কতবার বলে শেষ পর্যন্ত আজ একটু সময় দিলে
বিশ একটা নিশ্বাস ফেলে অপরাধীর মতো বলল, আসলে খুব বড় একটা এক্সপেরিমেন্ট দাঁড়া করছি আমরা। স্পেস টাইমের ওপর বিজ্ঞানী রিসানের একটা সূত্র আছে। সেটা প্রথমবার আমরা পরীক্ষা করে দেখছি। সেটা যে কত গুরুত্বপূর্ণ এক্সপেরিমেন্ট সেটা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না।
আমি কল্পনা করতে চাইও না।
আমি যেটা করতে চাইছি সেটা যদি করতে পারি দেখবে সারা পৃথিবীতে হইচই পড়ে যাবে।
চাই না আমি কোনো হইচই।
কী চাও তুমি?
আমি চাই তুমি সারাক্ষণ আমার পাশে থাকবে।
রিশ শব্দ করে হেসে উঠল এবং ঠিক তখন বুঝতে পারল তার পকেটের কমিউনিকেশন মডিউলটি একটা জরুরি সঙ্কেত দিতে শুরু করেছে। কেউ একজন তার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে। বিশ চোখের কোনা দিয়ে বীপাকে এক নজর দেখে পকেট থেকে ছোট কমিউনিকেশন মডিউলটি বের করল। সাথে সাথে বীপার চোখেমুখে এক ধরনের আশাভঙ্গের ছাপ পড়ল। সে আহত গলায় বলল, তুমি এখন এটিতে কথা বলবে?
রিশ অপরাধী গলায় বলল, আমাকে একটু কথা বলতে হবে বীপা। নিশ্চয় খুব জরুরি, খুব জরুরি না হলে সাত মাত্রায় যোগাযোগ করত না।
বীপা কিছু বলল না কিন্তু তার মুখে আশাহত হওয়ার ছাপটি খুব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অনুভূতির তারতম্যগুলো বীপার মুখে খুব সহজেই ধরা পড়ে যায়।
রিশ যোগাযোগ মডিউলটির সুইচ স্পষ্ট করতেই একজন মধ্যবয়স্ক মানুষের চেহারা স্পষ্ট হয়ে আসে। মানুষটি উত্তেজিত গলায় বলল, রিশ, যে চতুষ্কোণ ক্ষেত্রে শক্তি সঙ্কোচন করা হয়েছিল সেখানে সময়ক্ষেত্র ভেদ করা হয়েছে।
রিশ লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল, কী বলছ তুমি?
হা। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে একটা চতুষ্কোণ জায়গা, আলো প্রতিফলিত হয়ে আসছে, একটা আয়নার মতো!
সত্যি?
সত্যি। কতক্ষণ রাখতে পারব জানি না। প্রচণ্ড শক্তি ক্ষয় হচ্ছে। তুমি তাড়াতাড়ি চলে আস।
আসছি, আমি এক্ষুনি আসছি।
রিশ যোগাযোগ মডিউলটি বন্ধ করে হতচকিতের মতো বীপার দিকে তাকাল, তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না। তার চোখ চকচক করতে থাকে, কাঁপা গলায় বলল, শুনেছ বীপা, শুনেছ?
বীপার নীল চোখে তখনো একটা বিষণ্ণ আশাভঙ্গের ছাপ। সে মৃদু গলায় বলল, শুনেছি।
আমাকে যেতে হবে বীপা, আমাকে এক্ষুনি যেতে হবে।
বীপা চোখ নামিয়ে বলল, যাও।