জি স্যার, একটা সিংগুলারিটিতে কখনো যাওয়া যাবে কি না সন্দেহ আছে কিন্তু আরেকটায় মনে হয় সহজে যাওয়া যাবে। গতিবেগ বাড়াতে বাড়াতে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে হঠাৎ করে এক্সেলেরেশানটা একটা নির্দিষ্ট টাইমে পাল্টে দিতে হবে, তারপর আবার
উত্তেজনায় প্রফেসর জগলুলের হৃৎপিণ্ড প্রায় থেমে গেল কিন্তু তিনি আলাউদ্দিনকে কিছু বুঝতে দিলেন না। উঠে দাঁড়িয়ে একটা ছোট হাই তুলে বললেন, বেশ বেশ ভালো এক্সারসাইজ করেছ। এখন একটু পড়াশোনা কর, সামনের সপ্তাহে একটা মিডটার্ম দিয়েছি মনে আছে তো?
আলাউদ্দিনের মুখে স্পষ্ট একটা আশাভঙ্গের ছাপ পড়ল। সে ম্লান মুখে বলল, আমি অনেকবার ক্যালকুলেশানটা দেখেছি, কোনো ভুল নেই স্যার, শুধু এক্সেলেরেশান কন্ট্রোল করে একটা জিনিসকে অল্প একটু ভবিষ্যতে পাঠানো যাবে। একবিন্দু ভবিষ্যৎ কিন্তু সেখান থেকে আর ফিরে আসবে না আর দেখা হবে না–
প্রফেসর জগলুল টেবিল থেকে একটা বই নিয়ে হেঁটে বের হয়ে যাবার ভান করে বললেন, তোমরা মনে হয় পাঠ্যবই না পড়ে আজেবাজে সায়েন্স ফিকশান পড়। সায়েন্স আর সায়েন্স ফিকশান এক জিনিস না।
খাতাটা রেখে যাব স্যার? একটু দেখবেন স্যার?
ঠিক আছে রেখে যাও। সময় পেলে দেখব। আমার তো তোমাদের মতো সময় নেই। কত কাজকর্মে ব্যস্ত থাকতে হয় জন।
প্রফেসর জগলুল ঘর থেকে বের হয়ে আলাউদ্দিনকে চলে যাবার সময় দিয়ে প্রায় সাথে সাথেই ফিরে এসে আলাউদ্দিনের খাতাটার উপরে ঝুঁকে পড়লেন। তার হৃৎপিণ্ড ধকধক শব্দ করতে থাকে, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম, উত্তেজনায় তিনি নিশ্বাস নিতে পারছেন না। একটা নোবেল প্রাইজ তার হাতের মুঠোয় চলে এসেছে, কেউ আর সেটা আটকাতে পারবে না। কেউ না! আলাউদ্দিন যে সিংগুলারিটির কথা বলেছে সেটার নাম হবে জগলুল সিংগুলারিটি! বিজ্ঞানের ইতিহাসে পাকাঁপাকিভাবে তার নাম সোনার অক্ষরে লেখা হয়ে যাবে।
.
বেশ রাতে প্রফেসর জগলুল বাসায় ফিরে যাচ্ছেন, বহুদিনের পুরোনো লক্কড়–ঝক্কড় একটা ভক্সওয়াগন গাড়ি, কোনোমতে এখনো চলছে। আর কয়দিন, তারপর এই তুচ্ছ গাড়ির কথা আর চিন্তা করতে হবে না। কে জানে টাইম নিউজউইক পত্রিকায় এই লক্কড়–ঝক্কড় গাড়ি নিয়েই তার ছবি ছাপা হবে, বিশাল প্রতিবেদন ছাপা হবে! প্রফেসর জগলুল অন্ধকারে দাঁত বের করে হাসলেন।
ইউনিভার্সিটি থেকে বের হয়ে প্রফেসর জগলুল ডান দিকে ঘুরে গেলেন। রাস্তাটা খারাপ, তাকে খুব সাবধানে গাড়ি চালাতে হয়। গাড়ি চালাতে চালাতে তিনি আলাউদ্দিনের এক্সপেরিমেন্টের কথা ভাবতে লাগলেন, সে যে এক্সপেরিমেন্টের কথা বলেছে সেটা খুবই সহজ। একটা বস্তুকে নির্দিষ্ট ত্বরণে এগিয়ে নিয়ে ত্বরণকে পরিবর্তন করতে হয়, নির্দিষ্ট সময় পর আবার। যদি ত্বরণের পরিবর্তনের সাথে সময়ের একটা সামঞ্জস্য রাখা যায় তাহলেই স্পেস টাইমের সেই সিংগুলারিটিতে পা দেয়া যায়, যেটাকে আর কয়দিন পরেই বলা হবে জগলুল সিংগুলারিটি! সেই জগলুল সিংগুলারিটি দিয়ে বস্তু বের হয়ে চলে যায় ভিন্ন জগতে এক চিলতে সময় সামনে। মাত্র এক চিলতে সময় কিন্তু সেই সময়ের সাথে এই সময়ের কোনো যোগাযোগ নেই।
পুরো ব্যাপারটা চিন্তা করে প্রফেসর জগলুল মনে মনে হাসলেন। যখন তিনি পৃথিবীর নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে জগলুল সিংগুলারিটির ওপর সেমিনার দেবেন তখন তিনি ব্যাপারটি নিয়ে। রসিকতা করবেন। বলবেন, মনে কর কেউ গাড়ি করে যাচ্ছে। ফাঁকা রাস্তা তাই এক্সেলেটরে চাপ দিয়েছে, হঠাৎ দেখল সামনে একটা স্পিড বাম্প। ব্রেক কষার আগেই গাড়ি লাফিয়ে উঠল উপরে, তারপর নেমে আসল নিচে, ধাক্কা খেয়ে গাড়ি চলে গেল বামে, কোনোমতে ব্রেক কষতেই গাড়ি ঝাঁকুনি দিয়ে থামতে গেল–হঠাৎ করে দেখবে গাড়ি পা দিয়েছে জগলুল সিংগুলারিটিতে। স্পেস টাইমের ফুটো দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে অন্য জগতে–
হঠাৎ করে প্রফেসর জগলুল চমকে উঠলেন। রাস্তার পাশে দিয়ে মাথা নিচু করে হেঁটে যাচ্ছে আলাউদ্দিন, এক হাতে ধরে রাখা অনেকগুলো বইপত্র, মাথা নিচু করে হাঁটছে– পৃথিবীর কোনো কিছুতে তার কোনো খেয়াল আছে বলে মনে হয় না। প্রফেসর জগলুলের বুকের ভিতর হঠাৎ রক্ত ছলাৎ করে উঠল, গাড়িটা বাম পাশে ঘেঁষে আলাউদ্দিনকে একটা ধাক্কা দিলে কেমন হয়, ছিটকে পড়বে নিচে, তখন বুকের ওপর দিয়ে চালিয়ে নেবেন গাড়িটা–তার নোবেল প্রাইজের একমাত্র প্রতিবন্ধক শেষ হয়ে যাবে চোখের পলকে।
প্রফেসর জগলুল পিছনে তাকালেন, এই রাস্তাটা নির্জন এমনিতে লোকজন গাড়ি রিকশা থাকে না, আজকে আরো কেউ নেই। আলাউদ্দিনকে শেষ করার এই সুযোগ! পৃথিবীর কেউ জানতে পারবে না। প্রফেসর জগলুলের নিশ্বাস দ্রুত থেকে দ্রুততর হয়ে আসে, স্টিয়ারিং হুইল শক্ত করে ধরে রেখে তিনি এক্সেলেটরে চাপ দিলেন। তার লক্কড়–ঝক্কড় ভক্সওয়াগনটি হঠাৎ গর্জন করে ছুটে গেল সামনে, আঘাত করল আলাউদ্দিনকে, দেখতে পেলেন ছিটকে যাচ্ছে সে, ব্রেক কষলেন একবার তারপর স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে গাড়িটাকে ঘুরিয়ে নিতে। পিষে
ফেলতে হবে আলাউদ্দিনকে, শেষ করে দিতে হবে একমাত্র সমস্যাটিকে!
কিছু একটাতে তিনি আঘাত করলেন এবং হঠাৎ করে মনে হল তিনি পড়ে যাচ্ছেন। চমকে উঠে তিনি স্টিয়ারিং হইলটাকে শক্ত করে ধরে রাখলেন। অবাক হয়ে দেখলেন তার সামনে রাস্তা, রাস্তার পাশে দোকানপাট, লাইটপোস্টের হলুদ আলো, রাস্তায় ছিটকে পড়ে থাকা আলাউদ্দিনের শরীর সবকিছু অদৃশ্য হয়ে গেছে। চারদিকে কুয়াশার মতো এক ধরনের অতিপ্রাকৃত আলো, সেই আলোতে যতদূর দেখা যায় কোথাও কিছু নেই, চারদিকে শুধু শূন্যতা। এক ভয়াবহ শূন্যতা।