.
তিন দিন পরে আলাউদ্দিন তার খাতা ফেরত নিতে এল। প্রফেসর জগলুল ভান করলেন কী খাতা কী বৃত্তান্ত তিনি সব ভুলে গেছেন। খানিকক্ষণ চেষ্টা করে হঠাৎ মনে পড়েছে এ রকম ভান করে বললেন, ও, তোমার সেই অবাস্তব সলিউশানের ক্যালকুলেশান?
জি স্যার। দেখেছিলেন?
ঘুঁটিয়ে দেখার সময় পাই নি, শুধু চোখ বুলিয়ে দেখেছি এক দিন। ট্রিটমেন্ট তো পুরোনো। আজকাল এই ক্যালকুলেশান কেউ টেনসর দিয়ে করে না, ডায়াডিক দিয়ে করে।
কিন্তু স্যার সলিউশানটা?
প্রফেসর জগলুল ঘাড় বাঁকালেন, বললেন যে জিনিস কোনোদিন পরীক্ষা করা যাবে না সেটা থাকলেই কী আর না থাকলেই কী। একটা ইকুয়েশানের তো কতই সলিউশান থাকে, একটা ফেজ লাগিয়ে দিলেই তো নতুন সলিউশান। নতুন সলিউশান মানে তো আর নতুন ফিজিক্স না। যাই হোক, আমি বলি কী–
কী স্যার? আলাউদ্দিন আগ্রহ নিয়ে তাকাল।
সামনে ফাইনাল পরীক্ষা। এইসব বড় বড় জিনিস বাদ দিয়ে পড়াশোনা কর। ভালো একটা রেজাল্ট করতে পারলে অনেক কাজ হবে।
আলাউদ্দিন খুব মনমরা হয়ে তার খাতাটা নিয়ে বের হয়ে গেল।
প্রফেসর জগলুল পরের এক সপ্তাহ রাত জেগে কাজ করে একটা পেপার দাঁড়া করালেন। তার নিজের সত্যিকার কোনো কাজ করতে হল না, পুরোটা করে রেখেছে। আলাউদ্দিন। তার কাজ হল ব্যাপারটা প্রকাশ করার জন্যে লেখাটা দাঁড় করানো কিছু টেবিল, দুটো ফিগার এবং পেপারের শেষে একগাদা রেফারেন্স। ব্যাপারটা নিয়ে পৃথিবীর বিজ্ঞানীদের মাঝে কী রকম হইচই পড়ে যাবে এবং তিনি কেমন করে এক ইউনিভার্সিটি থেকে অন্য ইউনিভার্সিটিতে সেমিনার দিয়ে দিয়ে বেড়াবেন সেটা চিন্তা করে তার চোখমুখ আনন্দে ঝলমল করতে থাকে।
.
সপ্তাহ দুয়েক পরে এক ভোরবেলায় আলাউদ্দিন প্রফেসর জগলুলের ঘরে হাজির হল, তার হাতে সেই খাতা এবং চোখেমুখে এক ধরনের উত্তেজনা। তার চুল উষ্কখুষ্ক এবং চোখের নিচে কালি। দেখে মনে হয় সারারাত ঘুমায় নি। দরজায় দাঁড়িয়ে বলল, আসতে পারি স্যার?
প্রফেসর জগলুল ভিতরে ভিতরে কৌতূহলী হয়ে উঠলেও মুখে নিরাসক্ত ভাবটা ধরে রেখে গলার স্বরে প্রচ্ছন্ন একটু বিরক্তি এবং অসহিষ্ণুতা ফুটিয়ে বললেন, কী ব্যাপার?
আলাউদ্দিন এগিয়ে এসে বলল, স্যার মনে আছে আপনি বলেছিলেন–যে থিওরি এক্সপেরিমেন্ট করে পরীক্ষা করা যায় না তার কোনো মূল্য নেই?
প্রফেসর জগলুল হাই তোলার মতো ভঙ্গি করে বললেন, বলেছিলাম নাকি? মনে নেই আমার।
জি স্যার। আপনি বলেছিলেন। বলেছিলেন যে থিওরি এক্সপেরিমেন্ট করে প্রমাণ করা যায় না সেটা হচ্ছে ধর্মশাস্ত্র।
প্রফেসর জগলুল ভুরু কুঁচকে বললেন, কী হয়েছে তাতে?
আমি স্যার একটা এক্সপেরিমেন্ট বের করেছি। একটা উপায় আছে এক্সপেরিমেন্ট করার।
প্রফেসর জগলুলের হৃৎস্পন্দন প্রায় থেমে গেল। বলে কী ছেলেটা? সাদাসিধে চেহারার এই ছেলেটা বাজে কথার মানুষ না সেটা তিনি এতদিনে বেশ ভালো করে বুঝে গেছেন। সত্যি যদি সে এই তত্ত্বটার এক্সপেরিমেন্ট দাঁড় করিয়ে থাকে তাহলে একটা নোবেল প্রাইজ কেউ আটকাতে পারবে না। তিনি জ্বলজ্বলে চোখে নিশ্বাস বন্ধ করে আলাউদ্দিনের দিকে তাকিয়ে রইলেন, এই ছেলেটার কারণে একটা নোবেল প্রাইজ তার ধরাছোঁয়ার ভিতরে চলে এসেছে–সেটা যেন কিছুতেই হাতছাড়া না হয়। কিন্তু পুরো ব্যাপারটা করতে হবে খুব সাবধানে। আলাউদ্দিন যেন কিছুতেই বুঝতে না পারে। প্রথমে ব্যাপারটা তার কাছ থেকে বের করে আনতে হবে তারপর অন্য কিছু। একবার প্রাইজটা পেয়ে যাবার পর এই ছেলে যতই চেঁচামেচি করুক কেউ বিশ্বাস করবে না। উনিশ-বিশ বছরের একটা ছাত্রের কথা কে বিশ্বাস করবে? যদি সেরকম ঝামেলা দেখা যায় তাহলে অন্য কিছু ব্যবস্থা করা যাবে। আজকাল টাকা দিয়ে কত কী করে ফেলা যায় আর একজন মানুষকে সরিয়ে দেয়া এমন কী কঠিন ব্যাপার? কিন্তু সেটা নিয়ে মাথা গরম করে কী হবে? তার জন্যে অনেক সময় পাওয়া। যাবে।
আলাউদ্দিন আবার বলল, স্যার, দেখবেন আমার ক্যালকুলেশানটা?
দেখার জন্যে প্রফেসর জগলুলের সমস্ত শরীর বুক চোখ হা হা করতে থাকে কিন্তু তিনি জোর করে মুখে নিরাসক্ত ভাবটা ধরে রাখলেন, ঠাণ্ডা গলায় বললেন, আমার একটা ক্লাস রয়েছে এখন তো পারব না। যদি চাও তো খাতাটা রেখে যেতে পার, সময় পেলে দেখব।
তাহলে স্যার আপনাকে একটু বলি?
প্রফেসর জগলুল ইচ্ছে করে একবার ঘড়ির দিকে তাকালেন, তার সময় খুব মূল্যবান ব্যাপারটি আলাউদ্দিনকে খুব ভালো করে বুঝিয়ে দিয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বললেন, কী বলবে তাড়াতাড়ি বল।
স্যার মনে আছে আপনাকে বলছিলাম স্পেস যেরকম ছড়ানো, টাইম বা সময় ঠিক একইভাবে ছড়ানো? এই মুহূর্তে যেরকম অতীত আছে সেরকম বর্তমানও আছে?
আলাউদ্দিন কী বলছে প্রফেসর জগলুলের বুঝতে কোনো অসুবিধে হল না কিন্তু তিনি –বোঝার ভান করে বললেন, বলে যাও–
স্পেসে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে হলে সবসময় খানিকটা সময় অতিক্রম করতে হয়। ঠিক সেরকম এক সময় থেকে অন্য সময় যেতে হলে খানিকটা স্পেস অতিক্রম করতে হবে।
কতটুকু স্পেস?
আলাউদ্দিনের চোখ জ্বলজ্বল করতে থাকে। সে নিশ্বাস নিয়ে বলল, বিশাল স্পেস। বিলিয়ন বিলিয়ন মাইল। কিন্তু
কিন্তু কী?
আমি ক্যালকুলেশান করে দেখেছি এই স্পেস টাইমের কন্টিনিউয়ামে দুইটা সিংগুলারিটি রয়েছে।