ক্যালকুলেশানটা দেখলেই বুঝবেন স্যার, তবে আমি এমনি বলে দিই। আমাদের ধারণা সময় আগে অতীত থাকে, তারপর বর্তমানে আসে, সেখান থেকে ভবিষ্যতে যায়।
সে ধারণাটা সত্যি না?
সত্যি না আবার সত্যি–আলাউদ্দিন দাঁত বের করে একটু হাসল। প্রফেসর জগলুল এবারে একটু রেগে গেলেন, বললেন, কী বলতে চাইছ পরিষ্কার করে বল।
বলছি যে স্পেস যেরকম পুরোটা একসাথে রয়েছে, সময় সেরকম পুরোটা একসাথে রয়েছে। অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ পুরোটা।
পুরোটা? প্রফেসর ভুরু কুঁচকে বললেন, পুরোটা?
আলাউদ্দিন একটু থতমত খেয়ে বলল, জি স্যার পুরোটা। এই যে দেখেন স্যার এইখানে ক্যালকুলেশান করেছি।
প্রফেসর জগলুল জটিল সমীকরণটির দিকে তাকিয়েই হঠাৎ করে বুঝে গেলেন আলাউদ্দিন কী বলতে চাইছে এবং তিনি ভীষণভাবে চমকে উঠলেন। এই সাদাসিধে ছেলেটি একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার করে ফেলেছে কিন্তু সে নিজে সেটা নিশ্চয়ই জানে না। প্রফেসর জগলুল তার চেহারায় কিছু বুঝতে দিলেন না। বিরক্তি মেশানো প্রচ্ছন্ন বিদ্রুপের ভাবটা ধরে রেখে একটু রাগ–রাগ চোখে আলাউদ্দিনের দিকে তাকিয়ে রইলেন। আলাউদ্দিন একটু বিব্রত হয়ে খানিকটা লজ্জা পাওয়ার ভঙ্গিতে বলল, আমার ক্যালকুলেশান বলছে এখন যেটা অতীত সেটা যখন বর্তমানে চলে আসবে, তখন আমরা বর্তমান থেকে ভবিষ্যতে চলে যাব। কাজেই এখন যেটা অতীত সেটাকে কখনই আমরা দেখব না! ঠিক সেরকম এখন যেটা ভবিষ্যৎ সেটাও আমরা কখনো দেখব না–কারণ আমরা যখন ভবিষ্যতে যাব তখন যেটা ভবিষ্যতে আছে সেটা আরো ভবিষ্যতে চলে যাবে। কাজেই যদিও পুরো সময়টাই বর্তমান, আমরা আমাদের নিজেদের সময় ছাড়া কোনোটা দেখতে পাব না। যদিও অন্য সময়ের জন্যে হয়তো অন্য জগৎ রয়েছে, অন্য স্পেস রয়েছে
অন্য স্পেস রয়েছে?
হয়তো রয়েছে।
অন্য সময়ও আছে?
জি স্যার।
কিন্তু কখনো দেখতে পাব না?
না স্যার। আলাউদ্দিন মাথা চুলকে বলল, মনে হয় পারব না।
প্রফেসর জগলুল ভিতরে ভিতরে পুরো ব্যাপারটা নিয়ে এক ধরনের প্রবল উত্তেজনা অনুভব করতে থাকেন কিন্তু বাইরে নিস্পৃহ ভাবটা ফুটিয়ে রাখলেন। সম্পূর্ণ নিরাসক্ত গলায় বললেন, যে জিনিস প্রমাণ করা যায় না তবু বিশ্বাস করতে হয় সেটাকে বিজ্ঞান বলে না, সেটাকে বলে ধর্মশাস্ত্র। ধর্মে বলা হয় খোদাকে কেউ দেখতে পাবে না তবু তাকে বিশ্বাস। করতে হয়, তুমিও বলছ একই সাথে অতীত বর্তমান আর ভবিষ্যৎ রয়েছে কিন্তু কেউ দেখতে পাবে না তবুও বিশ্বাস করতে হবে
আলাউদ্দিন মাথা চুলকে বলল, কিন্তু আমি তো সেটা এমনি এমনি বলছি না, একটা ইকুয়েশানের সলিউশান থেকে বলছি। খোদার অস্তিত্ব নিয়ে তো কোনো ইকুয়েশান নেই–
উত্তরে প্রফেসর জগলুল বলার মতো কিছু পেলেন না বলে বিরক্তি এবং অসহিষ্ণুতার ভঙ্গি করে মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, ফিজিক্স হচ্ছে এক ধরনের বিজ্ঞান। বিজ্ঞানের প্রথম কথাই হচ্ছে তার সব থিওরি পরীক্ষা করে দেখা যাবে। যে বিজ্ঞানের থিওরি পরীক্ষা করা যায় না সেটা নিয়ে মাথা ঘামানো হচ্ছে সময় নষ্ট।
প্রফেসর জগলুলের রূঢ় উত্তরে জালাউদ্দিনের খুব আশাভঙ্গ হল এবং সে সেটা গোপন করার কোনো চেষ্টা করল না। একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, স্যার, তবু আমার খাতাটা একটু দেখবেন? ক্যালকুলেশানে কোথাও কোনো ভুল আছে কি না।
প্রফেসর জগলুল টেবিল থেকে একটা জার্নাল টেনে নিতে নিতে শীতল গলায় বললেন, ঠিক আছে রেখে যাও। যদি সময় হয় দেখব।
আলাউদ্দিন খাতাটা তার টেবিলের উপর রেখে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। যতক্ষণ সে ঘর থেকে পুরোপুরি বের হয়ে না গেল প্রফেসর জগলুল জার্নালের দিকে তাকিয়ে রইলেন, কিন্তু সে বের হওয়ার সাথে সাথে তিনি আলাউদ্দিনের খাতার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। উত্তেজনায় তিনি নিশ্বাস নিতে পারছেন না, তার চোখ জ্বলজ্বল করতে থাকে। তিনি লোভাতুর দৃষ্টিতে খাতার পৃষ্ঠা উল্টান, এখানে যে পরিমাণ কাজ করা হয়েছে সেটা দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফিজিক্যাল রিভিউয়ে তিন থেকে চারটা পেপার হয়। এটা প্রকাশ পাওয়ার সাথে সাথে সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানীদের মাঝে হইচই পড়ে যাবার কথা। অনেকদিন থেকে তিনি সেরকম কোনো কাজ করছেন না। এই একটা কাজ দিয়েই তিনি সারা পৃথিবীতে একটা আলোড়ন তৈরি করে ফেলতে পারবেন।
প্রফেসর জগলুল আলাউদ্দিনের খাতার পৃষ্ঠা উল্টাতে উল্টাতে বুকের ভিতরে ঈর্ষার এক ধরনের তীব্র খোঁচা অনুভব করতে থাকেন। এই জটিল অঙ্কগুলো আঠার–উনিশ বছরের একটি ছেলের কাজ, ব্যাপারটা তার বিশ্বাস হতে চায় না। তিনি ঘুঁটিয়ে ঘুঁটিয়ে দেখেন এবং কিছুক্ষণের মাঝেই তিনি নিঃসন্দেহ হয়ে যান আলাউদ্দিন যেটা বলেছে সেটা সত্যি, স্পেস যেরকম একই সাথে পুরোটুকু ছড়িয়ে আছে, সময়ও সেরকম একই সাথে পুরোটা ছড়িয়ে আছে। সময়ের প্রত্যেকটা বিন্দু থেকে সবকিছু ভবিষ্যতে এগিয়ে যাচ্ছে তাই কেউ কারো খোঁজ পাচ্ছে না। কোনোভাবে কেউ যদি হঠাৎ এক বিন্দু থেকে অন্য বিন্দুতে উপস্থিত হয়, সে দেখবে পুরোপুরি ভিন্ন এক জগৎ! প্রফেসর জগলুল লম্বা একটা নিশ্বাস নিলেন, এর একটা সুন্দর নাম দিতে হবে, সেই নাম নিয়ে তিনি পৃথিবীতে বিখ্যাত হয়ে যাবেন।
প্রফেসর জগলুল আলাউদ্দিনের খাতাটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন, কেউ দেখার আগে পুরো খাতাটা গোপনে ফটোকপি করে নিতে হবে। মাস তিনেক পর অস্ট্রেলিয়াতে একটা কনফারেন্স আছে, মনে হয় সেটাতেই প্রথম পেপারটা দেয়া যায়। আলাউদ্দিন যেন কিছুতেই জানতে না পারে, সেটা অবশ্যি সমস্যা হবার কথা নয়, এখানে জার্নাল পেপার এসব বলতে গেলে প্রায় আসেই না।