আলাউদ্দিন এবারে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, জি স্যার, শুনছি।
বল দেখি ট্রান্সফর্মেশান মেট্রিক্সটা কী রকম?
বই খাতা না দেখে শুধু স্মৃতির ওপর নির্ভর করে ট্রান্সফর্মেশান মেট্রিক্সটা বলা সম্ভব নয় কিন্তু আলাউদ্দিন মোটেও বিচলিত না হয়ে বলতে শুরু করল এবং কিছুক্ষণ শুনেই প্রফেসর জগলুল বুঝতে পারলেন আলাউদ্দিন ঠিকই বলছে। এতে তার রাগ আরো বেড়ে গেল, তিনি আরো জোরে গর্জন করে বললেন, আগে থেকে পড়ে এসে ক্লাসে বিদ্যা ফলানো ক্লাস এটেন্ড করা নয়। ক্লাসে এলে মনোযোগ দিতে হবে।
আলাউদ্দিন একটু বিব্রত হয়ে নিচু গলায় বলল, আমি মনোযোগ দিচ্ছি স্যার।
না তুমি মনোযোগ দিচ্ছ না। তুমি ছাদের দিকে তাকিয়ে আছ। আমি ক্লাসে কী বলছি তুমি শুনছ না, কী লেখছি তুমি দেখছ না।
দেখছি স্যার। এই দেখেন স্যার আমার খাতায় সব লেখা আছে। তাছাড়া
তাছাড়া কী?
আমি মনোযোগও দিচ্ছি স্যার। যেমন স্যার আপনি ব্ল্যাকবোর্ডে দুই নাম্বার লাইনে ইকুয়েশানটা ভুল লিখেছেন। ইনডেক্সগুলো উল্টাপাল্টা হয়ে গেছে। ছয় নাম্বার লাইনে এসে আবার ভুল করেছেন, সেই ভুলটা আগের ভুলটাকে শুদ্ধ করে দিয়েছে। সাত নাম্বার লাইন থেকে ইকুয়েশানটা আবার শুদ্ধ হয়েছে। যদি সেটা না হত ইমাজিনারি উত্তর আসত।
প্রফেসর জগলুল বোর্ডের দিকে তাকালেন, ভুলটা চোখে পড়তে তার অনেকক্ষণ সময় লাগল, এবং যখন সেটা তার চোখে পড়ল তিনি স্তম্ভিত হয়ে গেলেন, তার মুখে হঠাৎ রক্ত উঠে এল এবং লজ্জায় তার কান ঝা ঝা করতে লাগল। তিনি ডাস্টার দিয়ে ব্ল্যাকবোর্ডের লেখা মুছে শুদ্ধ করতে করতে বিড়বিড় করে বললেন, আমার নোটবইয়ে ঠিকই লেখা রয়েছে, বোর্ডে তুলতে ভুল হয়েছে।
আলাউদ্দিন হাসি–হাসি মুখ করে না–সূচকভাবে মাথা নাড়ল, প্রফেসর জগলুল সেটা দেখতে পেলেন না, কোনোভাবে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, বস।
স্যার আমি কী ভাবছিলাম সেটা কি আপনাকে একটু বলতে পারি?
প্রফেসর জগলুল থমথমে গলায় বললেন, আমি ক্লাসে অন্য জিনিস নিয়ে কথা বলা পছন্দ করি না।
এটা অন্য জিনিস না স্যার। রিলেটিভিটির একটা ব্যাপার। স্পেস টাইম কন্টিনিউয়ামের একটা সহজ ইকুয়েশান—
প্রফেসর জগলুল তাকে কথার মাঝখানে থামিয়ে দিয়ে বললেন, তুমি সেটা নিয়ে অন্য সময় কথা বোলো
আলাউদ্দিনের মুখে একটা আশাভঙ্গের ছাপ পড়ে, সে সেটা গোপন করার চেষ্টা করতে করতে নিজের জায়গায় বসে পড়ল। প্রফেসর জগলুল আবার বোর্ডে লিখতে শুরু করলেন, খুব স্বতঃস্ফূর্তভাবে আর পড়াতে পারছেন না, আলাউদ্দিন তার মেজাজটাকে একটু খিঁচড়ে দিয়েছে। প্রতিভাবান ছাত্ররা সাধারণত শিক্ষকদের প্রিয় হয়, কিন্তু সেই প্রতিভাটা যদি শিক্ষকদের দৈনন্দিন জীবনের জন্যে হুমকি হয়ে দাঁড়ায় তখন ছাত্রটির মাঝে ভালো লাগার কিছু খুঁজে পাওয়া কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। আলাউদ্দিন নামক এই সাদাসিধে গোবেচারা ধরনের ছাত্রটির বিরুদ্ধে তিনি এক ধরনের বিজাতীয় বিদ্বেষ অনুভব করতে লাগলেন।
.
দুপুরবেলা সাধারণত ক্লাস–সেমিনার থাকে না, তখন প্রফেসর জগলুল জার্নাল নিয়ে বসেন। নতুন কী কাজ হয়েছে খোঁজখবর নেন, নিজের রিসার্চের কাজকর্ম করেন। তিনি তাত্ত্বিক মানুষ, বেশিরভাগ কাজই কাগজ আর কলম নিয়ে বসে থাকা। আজকেও কাগজ কলম নিয়ে বসেছেন ঠিক এ রকম সময় দরজায় আলাউদ্দিন এসে দাঁড়াল। ছোটখাটো চেহারা, মাথার চুল এলোমেলো, চোখে সস্তা ফ্রেমের চশমা, শার্টটা একটু লম্বা, পায়ে স্যান্ডেল–দেখেই বোঝা যায় নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। চোখে হয়তো বুদ্ধির ছাপ আছে, থাকলেও সেটা মোটা চশমার আড়ালে ঢাকা পড়ে আছে। আলাউদ্দিন দরজায় দাঁড়িয়ে বলল, আসতে পারি স্যার?
প্রফেসর জগলুলের ভুরু কুঞ্চিত হল, তিনি একবার ভাবলেন বলবেন না। কিন্তু বলতে পারলেন না। একজন শিক্ষককে সবসময় তার ছাত্রদের কাছে আসতে দিতে হয়। তিনি সরাসরি তাকে আসতেও বললেন না, জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার?
একটা জিনিস নিয়ে একটু আলাপ করতে চাইছিলাম।
কী জিনিস?
স্পেস টাইম কন্টিনিউয়ামের একটা ইকুয়েশান। আমি লিখে এনেছি, একটু যদি দেখে দেন।
প্রফেসর জগলুল বিরক্ত গলায় বললেন, নিয়ে এস।
আলাউদ্দিন একটু বিব্রত ভঙ্গিতে এগিয়ে এল। তার হাতে একটা বাঁধানো খাতা, সেই খাতাটা টেবিলের উপর রেখে বলল, এই যে ইকুয়েশানটা আছে স্যার, তার দুইটা সলিউশান। একটা আপনি ক্লাসে পড়িয়েছেন, আরেকটা অবাস্তব বলে বাদ দিয়েছেন।
হুঁ। কী হয়েছে তাতে?
যেই সলিউশানটা আপনি বাদ দিয়েছেন আমি সেটা দেখছিলাম স্যার। আমার মনে হয় সেটা অবাস্তব সলিউশান না
অবাস্তব না?
না স্যার। সময় সম্পর্কে আমাদের যেই ধারণা সেই ধারণার সাথে মিলছে না বলে আমরা বলছি এটা অবাস্তব। কিন্তু আমরা যদি সময় সম্পর্কে অন্য একটা ধারণা নিই। তাহলে–
অন্য ধারণা?
জি স্যার। এই দেখেন আমি ক্যালকুলেশান করেছি।
আলাউদ্দিন খাতাটি খুলে ধরল এবং ভিতরে তার টানা হাতে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা জটিল অঙ্ক দেখে প্রফেসর জগলুল ভিতরে ভিতরে হতবাক হয়ে গেলেও বাইরে সেটা প্রকাশ করলেন না। চোখেমুখে বিরক্তি মেশানো প্রচ্ছন্ন একটা বিদ্রূপের ভাব ধরে রাখলেন। নিরুৎসুক গলায় জিজ্ঞেস করলেন, কী ক্যালকুলেশান?