কিভাবে করা হয়?
কঠিন পরিশ্রমের মধ্যে তাদের রাখা হয়। কোনোরকম অবসর নেই। মানুষ চিন্তাটা করবে। কখন? খাবার টিকিট জোগাড় করার দুশ্চিন্তাতেই মানুষের সব সময় কেটে যায়। জীবন কাটিয়ে দিতে চায় কার্ডে কোনো দাগ না ফেলে। চিন্তার সময় কোথায়?
তবুও কেউ কেউ তো এর মধ্যেই চিন্তা করে।
হ্যাঁ তা করে। আমি করি। আমার মতো আরো কেউ কেউ হয়ত করে। এমন কাউকে যদি পেতাম, কত ভালো হত। কত কিছু জানার আছে।
মীর হাই তুলল। ইরিনা বলল, আপনার কি ঘুম পাচ্ছে?
হ্যাঁ পাচ্ছে।
আমি কি তাহলে চলে যাব?
মীর হেসে ফেলে বলল, তোমার মনে হয় যেতে ইচ্ছা করছে না।
ইরিনা লজ্জা পেয়ে গেল। তার সত্যি সত্যি যেতে ইচ্ছা করছে না। এই অদ্ভুত মানুষটির সঙ্গে আরো কিছু সময় থাকতে ইচ্ছা হচ্ছে। কিন্তু এই লোকটা তা টের পাওয়ায় খুব অস্বস্তি লাগছে।
ইরিনা।
জি বলুন।
তুমি কি বিয়ের পারমিট পেয়েছ?
না, পাই নি। আমার বয়স উনিশ, একুশের আগে তো পারমিট পাব না।
আমার তেত্রিশ। আমিও পাই নি। সম্ভবত আমাকে পারমিট দেবে না। এই ব্যাপারটাও কিন্তু রহস্যময়। ওরা যাকে ঠিক করে দেবে, তাকেই বিয়ে করতে হবে। এতে নাকি সুস্থ সুন্দর নীরোগ মানুষ তৈরি হবে। সুখী পৃথিবী।
আপনি তা বিশ্বাস করেন না?
না, করি না। ওদের বেশির ভাগ কথাই বিশ্বাস করি না। আমি নিজের মতো চলতে চাই, নিজের মতো ভাবতে চাই। নিজের পছন্দের মেয়েটিকে বিয়ে করতে চাই।
এ রকম কোনো পছন্দের মেয়ে কি আপনার আছে?
না নেই। তোমাকে কিছুটা পছন্দ হয়। তবে তোমার মুখ গোলাকার। এ রকম মুখ আমার পছন্দ না।
আর আপনি বুঝি রাজপুত্ৰ?
কি মুশকিল, তুমি রাগ করছ, কেন? তোমাকে আমার কিছুটা পছন্দ হয়েছে, এই খবরটা বললাম। এতে তো খুশি হবার কথা।
আপনাকেও তো আমার পছন্দ হতে হবে? আপনার নিজের চেহারাটা কেমন আপনি জানেন? আয়নায় কখনো নিজের মুখ দেখেছেন?
খুব খারাপ?
না, খুব ভালো। একেবারে রাজপুত্র।
এত রাগছ কেন তুমি? তোমাকে আমার কিছুটা পছন্দ হয়েছে, এটা বললাম। আমাকে তোমার অপছন্দ হয়েছে, এটা তুমি বললে। ব্যাস, ফুরিয়ে গেল।
আমি এখন যাচ্ছি।
খুব ভালো কথা, যাও। শুভ রাত্রি।
শুভ রাত্ৰি।
শোন ইরিনা, এরকম রাগ করে চলে যাওয়াটা ঠিক না। যাবার আগে মিটমাট করে ফেলা যাক।
কিভাবে মিটমাট করবেন?
চলো খাবার গাড়িতে যাই। চা-কফি বা অন্য কোন পানীয় খাওয়া যাক।
যাবে?
আমার ইচ্ছা করছে না।
ইচ্ছা না করলে থাক।
আচ্ছা ঠিক আছে চলুন।
ইচ্ছা করছে না। তবু যেতে চোচ্ছ কেন?
ইচ্ছা না করলেও তো আমরা অনেক কিছু করি। যাকে সহ্য হয় না। সরকারি নির্দেশে তাকে বিয়ে করি। ভালোবাসতে চেষ্টা করি।
তা করি। চল যাওয়া যাক।
এ্যাটেনডেন্ট রোবটটির সঙ্গে করিডোরে দেখা হল। মীর হাসিমুখে বলল, কি ধাঁধাটি পারলে?
চেষ্টা করছি, তবে আমার মনে হচ্ছে আপনি একটি অবাস্তব সমস্যা দিয়েছেন। একটা সাপ নিজেকে পুরোপুরি গিলে ফেলবে কী করে?
বেশ, তাহলে একটা বাস্তব সমস্যা দিচ্ছি। একটি বস্তু এক সেকেন্ডে চার ফুট যায়। পরবতী সেকেন্ডে যায় দুই ফুট, তার পরবতী সেকেন্ডে এক ফুট। এভাবে অর্ধেক করে দূরত্ব কমতে থাকে। বিশ ফুট দূরত্ব অতিক্রম করতে তার কত সময় লাগবে?
রোবটটি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। মীর বলল, তুমি একটি মহাগৰ্দভ। এই ধাঁধার সমাধান করা তোমার কর্ম না। যাও ভাগো। ইরিনা খিলখিল করে হেসে উঠল। রোবটটির মনে হচ্ছে আত্মসম্মানে লেগেছে। সে গম্ভীর গলায় বলল, চট করে তো আর সমস্যার সমাধান করা যাবে না। আমাকে ভাববার সময় দিন।
সময় দেয়া হল। অনন্তকাল সময়। বসে বসে ভাব।
দুজন মুখোমুখি বসেছে।
মীর কোনো কথা বলছে না। কপাল কুঁচকে কি জানি ভাবছে। গাড়ির গতি আগের চেয়ে কম। বাইরে নিকষ অন্ধকার, কিছুই দেখা যাচ্ছে না। আকাশে মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। সেই বিদ্যুতের আলোয় ধ্বংসস্তুপ মাঝে মাঝে চোখে পড়ছে। বীভৎস দৃশ্য, তাকান যায় না।
ইরিনা লক্ষ করল অরচ লীওন ঠিক আগের জায়গায় বসে। তার হাতে পানীয়ের গ্লাস। গ্লাসে গাঢ় সবুজ রঙের কি-একটা জিনিস- ক্ৰমাগত বুদবুদ উঠছে। অরচ লীওন তাকিয়ে আছেন তাঁর গ্রাসের দিকে। একবার ইরিনার সঙ্গে তার চোখাচৌখি হল। তিনি এমনভাবে তাকালেন, যেন চিনতে পারছেন না।
ইরিনা মৃদু স্বরে মীরকে বলল, ঐ লোকটিকে কি আপনি চেনেন?
কোন লোকটি?
ঐ যে কোণার দিকে বসে আছে। তক্ষকের মতো চোখ।
চিনব না কেন? উনি আমার বাবা।
কী বলছেন!! আমি তো জানতাম। উনি অবিবাহিত।
উনি আমার বাবা। ইন্টেলিজেন্সের সবচে বড়ো অফিসার। এরা হাসি মুখে রাতকে দিন করে। চেহারার মধ্যে তুমি মিল দেখছি না? অবিবাহিত হবে কেন? ইরিনা বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে আছে। কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। মীর খুব সহজ ভঙ্গিতে বলল, বাবার সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ নেই।
নেই কেন?
আমার জন্মের দ্বিতীয় বছরে বাবাকে প্ৰথম শহর থেকে দ্বিতীয় শহরে নিয়ে যাওয়া হল। আমার যখন আঠার বছর বয়স, তখন জানলাম তিনি অসাধ্য সাধন করেছেন। তৃতীয় শহরের নাগরিক হয়ে বসেছেন।
আপনার খোঁজখবর করেন না?
কী করে করবে, তৃতীয় শহরের নাগরিক না? তৃতীয় শহরের নাগরিকেরা কি আর প্রথম শহরের কাউকে খুঁজতে পারে, আইনের বাধা আছে না? তাছাড়া সে নিজেই হচ্ছে আইনের লোক।
আইনের লোক বলেই তো আইন ভাঙা সহজ।
তা ঠিক। সে আইন ভেঙেছে। আমার কার্ডে তেতাল্লিশটি দাগ পড়ার পরও কিন্তু আমি বেঁচে আছি। চল্লিশটি দাগ পড়ার পর সরকারি নিয়মে দোষী লোকটিকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়। অবাঞ্ছিত কেউ বেঁচে থাকে না, অথচ আমি আছি। হা হা হা।