তাহলে তোমার কি মনে হয়, আমি বুদ্ধিমান?
ইরিনা হাসবে না। কাঁদবে বুঝতে পারছে না। ইচ্ছা হল বলে, আপনি এর কোনোটাই না, আপনি পাগল। তা বলা গেল না।
তোমার নামটা যেন কি? আমাকে কি আগে বলেছিলে, না বল নি?
আমার নাম ইরিনা। শুরুতেই একবার বলেছি।
আমার নাম জানতে চাও?
আপনি ঘুমুতে চাচ্ছিলেন- ঘুমান। আমি এখন যাব।
আমার ঘুম নষ্ট হয়ে গেছে। একবার ঘুম নষ্ট হলে অনেক রাত পর্যন্ত আমার ঘুম আসে না। শোন আমার নাম অখুন-মীর। তুমি আমাকে মীর ডাকবে। আমার বন্ধুরা আমাকে মীর ডাকে। মীর উচ্চারণটা হবে একটু টেনে টেনে মী—র-এ রকম বুঝতে পারলে?
পারলাম।
বস এখানে।
ইরিনা বসল। কেন বসিল নিজেই জানে না। বসার তার কোনো রকম ইচ্ছা ছিল না।
শোন ইরিনা, নিষিদ্ধ নগরীতে যেতে হচ্ছে বলে তুমি এত ঘাবড়ে যাচ্ছ কেন? আমাদের ওদের প্রয়োজন বলেই নিয়ে যাচ্ছে। শাস্তি দেয়ার জন্যে নিশ্চয়ই নিচ্ছে না। শাস্তি দেবার হলো হলে প্ৰথম শহরেই দিতে পারত। পারত না?
হ্যাঁ পারত।
যে-কোনো কারণেই হোক। ওদের প্রয়োজন।
ইরিনা বলল, ওরা মানে কারা?
মীর কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে বসে রইল। যেন প্রশ্নের উত্তর নিয়ে ভাবছে, উত্তরটা মাথায় এলেই বলবে। বসে আছে তো বসে আছে। ইরিনার ক্ষীণ সন্দেহ হল, লোকটি বোধ হয় ঘুমিয়ে পড়েছে। গাড়ির ঢুলুনিতে ঘুমিয়ে পড়া বিচিত্র নয়। কি অদ্ভুত দেখাচ্ছে মানুষটাকে। কুঁজো হয়ে বসেছে। থুতনিটা ওপরের দিকে তোলা। হাত দুটি এলিয়ে দিয়েছে।
আপনি কি ঘুমিয়ে পড়লেন নাকি?
না। ভাবছি।
ভেবে কিছু পেলেন? আপনি তো বুদ্ধিমান লোক, পাওয়া উচিত।
তা উচিত, কিন্তু পাচ্ছি না। নিষিদ্ধ নগর সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না।
কেন জানি না?
এই জিনিসটা নিয়েই আমি ভাবছিলাম। কেন জানি না?
ভেবে কিছু বের করতে পারলেন?
না। শুধু একটা জিনিস বুঝতে পারছি, আমরা আসলে কিছুই জানি না। আমাদের যখন অসুখ হয়, একজন রোবট ডাক্তার এসে আমাদের চিকিৎসা করে। কেন আমাদের অসুখ হয়, কিভাবে আমাদের অসুখ সারানো হয়- তার কিছুই আমরা জনি না। কোনো যন্ত্রপাতি যখন নষ্ট হয়, একজন রোবট এসে তা ঠিক করে। যন্ত্রপাতিগুলো কী? কিভাবে কাজ করে-তাও আমরা জানি না। এখন কথা হল, কেন জানি না।
কেন?
কারণ আমাদের জানতে দেয়া হয় না। আমরা স্কুলে পড়াশোনা করি। কী পড়ি? লিখতে পড়তে শিখি। সামান্য অঙ্ক শিখি। প্রথম শহরে বিধিগুলো মুখস্থ করি। ব্যাস, এই পর্যন্তই। তাই না?
হ্যাঁ তাই।
বুঝলে ইরিনা, আমি একবার আমার স্যারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম—স্যার টেলিফোন কিভাবে কাজ করে? স্যার অবাক হয়ে অনেকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, টেলিফোন তৈরি করা হয়েছে মানুষের সেবার জন্যে। তৈরি হয়েছে নিষিদ্ধ নগরে। নিষিদ্ধ নগর সম্পর্কে কৌতূহল সপ্তম বিধি অনুসারে একটা প্রথম শ্রেণীর অপরাধ। তুমি একটি প্রথম শ্রেণীর অপরাধ করেছ। এই বলে তিনি আমার কার্ডে একটা দাগ দিয়ে দিলেন। হা হা হা।
ইরিনা বিরক্ত হয়ে বলল, হাসছেন কেন? এটা কি হাসার মতো কোনো ঘটনা? কার্ডে দাগ পড়া তো খুবই কষ্টের ব্যাপার। পনেরটার বেশি দাগ পড়লে আপনি কখনো দ্বিতীয় শহরে যেতে পারবেন না।
এই জন্যেই তো হাসছি। আমার কার্ডে মোট দাগ পড়েছে তেতাল্লিশটি। স্কুলে সবাই আমাকে কি বলে জান? সবাই বলে মিস্টার তেতাল্লিশ?
বিধি ভঙাই বুঝি আপনার স্বভাব?
না, তা না। আমার স্বভাবের মধ্যে আছে কৌতূহল। আমি কৌতূহল মেটাবার চেষ্টা করি। একবার কি করেছিলাম জান? পানি গরম করার একটা যন্ত্র খুলে ফেলেছিলাম।
কি বলছেন আপনি!
হ্যাঁ সত্যি। প্রথম খুব ভয় লাগল। কত বিচিত্র সব জিনিস। একটা চাকতি নির্দিষ্ট গতিতে ঘুরছে। তিন বার ঘুরবার পর অন্য একটা বলের মতো জিনিস চলে আসে সেটা খুব গরম।
আপনি হাত দিয়েছিলেন!
হাত না দিলে বুঝব কি করে এটা গরম না ঠাণ্ডা।
এর জন্যে আপনার কী শাস্তি হল?
কোনো শাস্তি হল না।
শাস্তি হল না কেন?
শাস্তি হল না। কারণ আমি আবার তা লাগিয়ে ফেলেছিলাম।
ইরিনা বিস্মিত হয়ে বলল, কীভাবে লাগালেন?
যেভাবে খুলেছিলাম সেভাবে লাগালাম।
বলেন কি আপনি!
এসব কাজ শুধু রোবটরা পারবে, আমরা পারব না, তা ঠিক না। আমাদের শেখালে আমরাও পারব। কিন্তু আমাদের কেউ শেখাচ্ছে না। এবং নানারকম বিধি-নিষেধ দিয়ে দিয়েছে যাতে আমরা শিখতে না পারি। যেন আমরা এসব শিখে ফেললে কোনো বড় সমস্যা হবে।
এই হাবাগোবা ধরনের মানুষটির প্রতি ইরিনার শ্রদ্ধা হচ্ছে, এ আসলেই বুদ্ধিমান। সবাই যেভাবে একটা জিনিসকে দেখে, এ সেভাবে দেখছে না। অন্যরকম করে দেখছে। সেই দেখার সবটাই যে ভুল, তাও না।
ইরিনা।
জি বলুন।
তুমি কি লক্ষ করেছ। এই রোবটগুলো শুধু দিনে কাজ করে, রাতে কিছু दGद क्रा?
না, আমি সেভাবে লক্ষ করি নি।
এরা দিনে কাজ করে। যখন এদের কোনো কাজ থাকে না, তখন রোদে দাড়িয়ে থাকে। এর মানে কি বলতো?
জানি না।
কাজ করবার জন্যে যে শক্তি লাগে তা তারা রোদ থেকে নেয়।
তাই নাকি?
হ্যাঁ তাই। একার পরপর চারদিন ধরে খুব ঝড়বৃষ্টি হল। সূর্যের মুখ দেখা গেল না। তখন অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, রোবটগুলো কোনো কাজ করতে পারছে না।
কিন্তু কিছু কিছু রোবট তো রাতেও কাজ করে। যেমন ডাক্তার রোবট।
হ্যাঁ, তা অবশ্যি করে।
অখুন-মীর একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল। যেন এই কথাটা তার খুব মনে লেগেছে। ডাক্তার রোবটরা রাতে কাজ না করলেই যেন সে বেশি খুশি হত। ইরিনা মানুষটিকে খুশি করার জন্যে বলল, হয়তো আপনি আপনার অনেক প্রশ্নের জবাব নিষিদ্ধ নগরীতে পেয়ে যাবেন। মীর ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলল, জানি না। পাব বলে মনে হয় না। প্রশ্নের জবাব কেউ দিতে চায় না। এবং মজার ব্যাপার কি জান ইরিনা, মানুষের মাথায় যেন এই জাতীয় কোনো প্রশ্ন না আসে। সেই চেষ্টা করা হয়।