দ্বিতীয় শহরে প্রচুর খাবার-দাবার। ফেলে ছড়িয়ে খেয়েও শেষ করা যায় না। রেশনের ব্যবস্থা নেই। যার যা প্রয়োজন, বাজার থেকে কিনে আনবে। কাজ করতে হবে মাত্র ছয় ঘণ্টা। নিয়ম-কানুনের কড়াকড়ি এখানে নেই। বড় রকমের অপরাধের শাস্তি জরিমানা। বছরে এক মাস দেয়া হয়। ভ্ৰমণ, পাস। সেই পাস নিয়ে যেখানে ইচ্ছা সেখানে ঘুরে বেড়ান যায়। একটি টাকাও খরচ হয় না। আর উৎসব তো লেগেই আছে। দ্বিতীয় শহরের জীবনে ক্লান্তি বা অবসাদ বলে কিছু নেই। এই শহরের নাগরিকরা দুঃখ ব্যাপারটা কি জানেই না, এরা শুধু স্বপ্ন দেখে তৃতীয় শহরের। কুড়ি বছর দ্বিতীয় শহরে বাস করতে পারলেই তৃতীয় শহরে যাবার যোগ্যতা হয়। কিন্তু সবাই যেতে পারে না। ভাগ্যবানদের ঠিক করা হয় লটারির মাধ্যমে। লটারিটা হয় বছরের শেষ দিনে। প্ৰচণ্ড আনন্দ ও উত্তেজনার একটি দিন। এক দল নির্বাচিত হন তৃতীয় শহরের জন্যে, তাদের ঘিরে সারারাত আনন্দ-উল্লাস চলে।
যাঁরা নির্বাচিত হন না, তারাও খুব একটা মন খারাপ করেন না। পরের বছর আবার লটারি হবে। সেই আশায় বুক বাঁধেন।
তৃতীয় শহরের সুখ-সুবিধা কেমন, সে সম্পর্কে কোনো স্পষ্ট ধারণা দ্বিতীয় শহরের নাগরিকদেরও নেই। তাঁরা শুধু জানেন, তৃতীয় শহর হচ্ছে স্বৰ্গপুরী। চির অবসর ও চির আনন্দের স্থান। সবাই ভাবেন— মৃত্যুর আগে একবার যেন তৃতীয় শহরে ঢুকতে পারি।
ইরিনা ছয় নম্বর কামরার সামনে এসে দাঁড়াল। কলিং বেল থাকা সত্ত্বেও সে দরজায় মৃদু টােকা দিল। ভেতর থেকে একজন কে শিশুর মতো গলায় বলল, কে?
আমি ইরিনা। আপনার সঙ্গে আমি একটু কথা বলতে চাই।
এখন তো কথা বলতে পারব না। আমি এখন ঘুমুব।
প্লীজ, একটু দরজা খুলুন। আমার খুব দরকার।
দরজা খুলে গেল। অসম্ভব রোগা একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। চোখে মোটা কাচের চশমা। লোকটি রুক্ষ গলায় বলল, তুমি কী চাও?
ইরিনা তার জবাব না দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল। লোকটি অবাক হয়ে তাকে দেখছে।
ট্রেনের গতিবেগ ক্রমেই বাড়ছে। বাতাসে শিসের মতো শব্দ হচ্ছে। এমন প্ৰচণ্ড গতি, যেন এই ট্রেন এক্ষুণি মাটি ছেড়ে আকাশে উড়ে যাবে। ইরিনা বলল, আমি কি বসতে পারি?
ছেলেটি হাবাগোবার মতো
ছেলেটি হাবাগোবার মতো। কিছু কিছু বয়স্ক মানুষ আছে, যাদের দেখলেই মনে হয় এরা কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা হাস্যকর কিছু করবে। এবং এটা যে হাস্যকর, তা বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে চারদিকে তাকাবে। একেও সে রকম লাগছে। মোটা ফ্রেমের চশমা। সেই চশমা নাকের ডগায় চলে এসেছে। দেখতে অস্বস্তি লাগছে। মনে হচ্ছে চশমা এই বুঝি খুলে পড়ল।
আমি কি আপনার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলতে পারি?
ছেলেটি বিরক্তি স্বরে বলল, একবার তো বললাম। আমি ঘুমুব।
আপনার ঘুম এতই জরুরি? ঘুম জরুরি না! ঠিক সময়ে ঘুমুতে যাওয়া উচিত এবং ঠিক সময়ে ঘুম থেকে ওঠা উচিত।
আজি না হয় একটু ব্যতিক্রম হল। বসব?
আমি না বললে কি তুমি শুনবে?
ছেলেটির মুখে তুমি শব্দটি খুব স্বাভাবিক শোনাল। খট করে কানে বাজল না। যেন এ অনেকদিন থেকেই ইরিনাকে চেনে, তুমি করে ডাকে।
জরুরী কথাটি কি?
আপনি যেখানে যাচ্ছেন আমিও সেখানে যাচ্ছি। আমি নিষিদ্ধ নগরীতে যাচ্ছি।
ছেলেটি অবাক হয়ে বলল, এটা এমন কি জরুরি কথা! আপনার কাছে খুব জরুরি মনে হচ্ছে না?
না তো!
আপনি খুবই বোকা।
তা ঠিক না। আমি বোকা হব কেন? আমার অনেক বুদ্ধি। এই জন্যেই তো আমাকে নিষিদ্ধ নগরীতে নিয়ে যাচ্ছে। আমি বোকা হলে আমাকে নিয়ে যেত? ইরিনার ইচ্ছে হল উঠে চলে যেতে। যাবার আগে এই হাঁদারামের গালে প্ৰচণ্ড একটা চড় বসিয়ে দিতে।
ছেলেটি বেশ অবাক হয়েই বলল, একি খুকী, আমার যে বুদ্ধি আছে, এটা তুমি বিশ্বাস করছ না কেন?
কোনো বুদ্ধিমান লোক কখনো বলে না, আমার খুব বুদ্ধি। শুধুমাত্র হাদারাই সে রকম বলে।
একজন বুদ্ধিমান লোক যদি বলে আমার খুব বুদ্ধি, তাতে দোষের কি?
না, কোনো দোষ নেই, আপনি যত ইচ্ছা বলুন। আর দয়া করে আমাকে তুমি তুমি করে বলবেন না।
ইরিনা সত্যি সত্যি উঠে দাঁড়াল। ছেলেটি দুঃখিত স্বরে বলল, তুমি আমার ওপর রাগ করে চলে যােচ্ছ, এই জন্যে আমার খারাপ লাগছে। মনে হচ্ছে তুমি আমার কথা বিশ্বাস কর নি। আমি প্রমাণ করে দেব যে আমার বুদ্ধি আছে?
আপনাকে কিছু প্ৰমাণ করতে হবে না।
না না শোন, শুনে যাও। আমার সম্পর্কে তোমার একটা ভুল ধারণা থাকবে, এটা ঠিক না। আমি এই ঘণ্টাখানেক আগে কী করে একটা বুদ্ধিমান রোবটকে বোকা বানালাম এটা শোন।
ইরিনা কৌতূহল হয়ে তাকাচ্ছে। ছেলেটি খুব উৎসাহের সঙ্গে বলছে, ট্রেনে একটা রোবট আছে দেখ নি? ব্যাটা আমার সাথে রসিকতা করবার চেষ্টা করছিল, আমাকে একটা ধাঁধা জিজ্ঞেস করল।
আর আপনি চট করে জবাব দিয়ে দিলেন?
না। আমি উল্টো তাকে একটা এমন ধাঁধা দিলাম ব্যাটার প্রায় মাথা খারাপ হবার জোগাড়।
কি ধাঁধা?
আমি বললাম, একটা সাপ হঠাৎ তার নিজের লেজটা গিলতে শুরু করল। পুরোপুরি যখন গিলে ফেলবে, তখন কী হবে? রোবটটার আক্কেল গুড়ুম। ভেবে পাচ্ছে না। কী হবে। একবার বলছে সাপটা অদৃশ্য হয়ে যাবে। পরীক্ষণেই মাথা নেড়ে বলছে, তা কি করে হয়?
এই আপনার বুদ্ধির নমুনা?
হ্যাঁ। দ্বৈত সন্দেহ ঢুকিয়ে দিয়েছি মাথায়। একটা রোবটকে বোকা বানানোর এই বুদ্ধি কি তোমার মাথায় আসত?
না, আসত না।