তোমাকে খানিকটা প্ৰফুল্ল লাগছে তার কারণ জানতে পারি কি?
কোনো কারণ নেই।
কারণ ছাড়া পৃথিবীতে কিছুই ঘটে না ইরিনা। আমার মনে হয় ঐ রোবটটার সঙ্গে তোমার প্রফুল্লতার একটা সম্পর্ক আছে। ওর দায়িত্ব হচ্ছে ট্রেনযাত্রীদের সবাইকে প্রফুল্ল রাখা। ও প্ৰাণপণে সেই চেষ্টা করে। ওর নানান কায়দা-কানুনের আছে। তোমার বেলা নিশ্চয়ই সব কায়দা-কানুনের কোনো একটা খাটিয়েছে। তোমার বেলা কী করেছে? গান গেয়েছে না কবিতা লিখে দিয়েছে?
ইরিনা তার জবাব না দিয়ে বলল, আমি কোথায় যাচ্ছি?
খাওয়া শেষ কর, তারপর বলব।
আমি এখনি শুনতে চাই।
তুমি যাচ্ছ নিষিদ্ধ নগরীতে।
ইরিনার গা দিয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল। তার মনে হল, সে ভুল শুনছে। সে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল। অরচ লীওন বললেন, তুমি যােচ্ছ নিষিদ্ধ নারীতেতে। আমি তোমাকে তৃতীয় নগরী পর্যন্ত নিয়ে যাব। সেখান থেকে রোবটবাহী বিশেষ বিমানে করে তুমি নিষিদ্ধ নগরীতে যাবে। আমি তোমার সঙ্গে যেতে পারব না, কারণ নিষিদ্ধ নগরীতে যাবার অনুমতি আমার নেই। ইরিনা, তুমি কি বুঝতে পারছি, তুমি কত ভাগ্যবতী?
না, আমি বুঝতে পারছি না।
গত চার শ বছরে দশ থেকে বারো জন মানুষের এই সৌভাগ্য হয়েছে।
তারা কেউ ফিরে আসে নি। কাজেই আমরা জানি না, তা সৌভাগ্য না দুৰ্ভাগ্য।
এই ধ্বংস হয়ে যাওয়া পৃথিবীকে যারা আবার ঠিক করেছে, পৃথিবীর যাবতীয় শাসন-ব্যবস্থা যাঁরা নিয়ন্ত্রণ করছেন, তাদের চোখের সামনে দেখবে। হয়তো তাদের সঙ্গে কথা বলবে। এটা কি একটা বিরল সৌভাগ্য নয়?
এত মানুষ থাকতে আমি কেন?
তা তো জানি না। তবে বিশেষ কোনো কারণ নিশ্চয়ই আছে। নিষিদ্ধ নগরীতে যাঁরা আছেন তাঁরা পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ সম্পর্কে জানেন। তাঁরা নিশ্চয়ই তোমার ভেতর কিছু দেখেছেন।
আমার মধ্যে কিছুই নেই।
তুমি কি পানীয় কিছু খাবে?
না।
তোমাকে সাহস দেবার জন্যে আরেকটি খবর দিতে পারি।
দিতে পারলে দিন।
নিষিদ্ধ নগরীতে তুমি একা যােচ্ছ না, তোমার এক জন সঙ্গী আছে। এই প্রথম একসঙ্গে তোমরা দুজন যাচ্ছি। এবং সবচে মজার ব্যাপার হচ্ছে, তোমার সেই সঙ্গী এই মুহুর্তে এই ট্রেনেই আছে। তুমি কি তার সঙ্গে আলাপ করতে চাও?
চাই।
সে আছে ছ নম্বর কামরায়। সে এক-একাই আছে। তুমি একাই যাও।
আপনি কি আমাদের পরিচয় করিয়ে দেবেন না?
না। নিজেই পরিচয় করে নাও।
ইরিনা উঠে দাঁড়াল। অরচ লীওন বললেন, আমি কি কোনো ধন্যবাদ পেতে পারি?
আপনাকে ধন্যবাদ অরচ লীওন।
আরেকটি খবর তোমাকে দিতে পারি। এই খবরে তুমি আরো খুশি হবে।
ইরিনা উঠে দাঁড়িয়েছিল। এই কথায় আবার বসল। অরচ লীওন গ্লাসে চুমুক দিয়ে বললেন তোমার বাবা-মা ভালো আছেন। তাদেরকে দ্বিতীয় শহরের নাগরিক করা হয়েছে। আমার কথা বিশ্বাস না হলে তুমি টেলিফোন করে খোজ নিতে পার। ট্রেন থেকেই তা করা যাবে।
ইরিনা তাকিয়ে আছে। কিছু বলছে না। অরচ লীওন বললেন, তুমি কি খুশি?
হ্যাঁ, আমি খুশি। এই খবরটি আপনি আমাকে শুরুতে বললেন না কেন?
শুরুতে তোমাকে আমি ভয় পাইয়ে দিতে চেয়েছি। আমি চেষ্টা করেছি যাতে ভয়ে, দুঃখে, কষ্টে, তুমি অস্থির হয়ে যাও।
তাতে আপনার লাভ?
লাভ অবশ্যই আছে। বিনা লাভে আমি কিছু করি না। শুরুতে প্ৰচণ্ড ভয় পেলে শেষের আনন্দের খবরগুলো খুব ভালো লাগে। তোমার এখন তাই লাগছে। তুমি আমার প্রতি কৃতজ্ঞ বোধ করছ। এখন আমি যদি তোমাকে কোনো অনুরোধ করি, তুমি তা রাখবে।
কী অনুরোধ করবেন?
নিষিদ্ধ নগরীতে তুমি কী দেখলে, তা আমি জানতে চাই। কোনো-না- কোনো ব্যবস্থা করে তুমি আমাকে তা জানাবে।
কেন জানতে চান?
কৌতূহল। শুধুই কৌতূহল, আর কিছুই না। এস তোমার বাবা-মার সঙ্গে কথা বলা যাক।
টেলিফোনে খুব সহজেই যোগাযোগ করা গেল। ইরিনার বাবা কথা বললেন। তাঁর গলায় বিন্দুমাত্ৰ উদ্বেগ নেই। তিনি আনন্দে ঝলমল করতে করতে বললেন, খুব বড় এটা খবর আছে মা, আমি এবং তোমার মা দুজনই দ্বিতীয় শহরের নাগরিক হয়েছে। কাগজপত্র পেয়ে গেছি।
খুবই আনন্দের কথা বাবা।
তোর মা তো বিশ্বাসই করতে পারছে না। আনন্দে কাঁদছে।
সেটাই তো স্বাভাবিক।
আগামী কাল বাসায় একটা উৎসবের মতো হবে। পরিচিতরা সব আসবে। উৎসবের জন্যে পঞ্চাশ মুদ্রা পাওয়া গেছে।
তাই নাকি!
হ্যাঁ। ঘর সাজাচ্ছি, আজ রাতে আর ঘুমাব না।
ইরিনা ক্ষীণ স্বরে বলল, আমার কথা তো কিছু জিজ্ঞেস করলে না? আমি কোথায় আছি, কী করছি।
এ তো আমরা জানি। জিজ্ঞেস করব কি?
কী জান?
বিশেষ কাজে তোকে নেয়া হচ্ছে। কাজ শেষ হলে তোকেও আমাদের সঙ্গে থাকতে দেবে।
ইরিনা একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলল, বাবা রেখে দিই।
তোর মার সঙ্গে কথা বলবি না।
না। বেচারী আনন্দে কাঁদছে, কাঁদুক। ভালো থেক তোমরা। শুভ রাত্রি। ইরিনা টেলিফোন নামিয়ে রাখল। বাবার ওপর সে কিছুতেই রাগ করতে পারছে না। প্ৰথম নাগরিক থেকে দ্বিতীয় নাগরিকের এই সৌভাগ্যে তার বোধ হয় মাথাই এলোমেলো হয়ে গেছে। সেটাই স্বাভাবিক।
নাগরিকত্বের তিনটি পর্যায় আছে। সবাইকেই এই তিনটি পর্যায়ের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। প্রথম পর্যায়ে প্রথম শহরের নাগরিকত্ব। সকাল আটটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত কাজ। মাঝখানে চল্লিশ মিনিটের ছুটি। সীমিত খাবারদাবার। ছুটির দিনে সপ্তাহের রেশন নিয়ে আসতে হয়। এক সপ্তাহ আর কোনো খাবার নেই। সপ্তাহের রেশন কৃপণের মতো খরচ করতে হয়। খাবারের কষ্টই সবচে বড় কষ্ট। তারপর আছে নিয়ম-কানুন মেনে চলার কষ্ট। একটু এদিকওদিক হবার উপায় নেই। কার্ডে লাল দাগ পড়ে যাবে। পনেরটি লাল দাগ পড়ে গেলে এ জীবনে আর দ্বিতীয় শহরে নাগরিক হওয়া যাবে না। সবাই প্ৰাণপণ চেষ্টা করে কার্ডটি পরিষ্কার রাখতে। সম্ভব হয় না। যেসব ভাগ্যবান ত্ৰিশ বছর বয়স পর্যন্ত তা পারেন, তারা দ্বিতীয় শহরের নাগরিক হিসেবে নির্বাচিত হন।