ইরিনা যেভাবে বসেছিল, সেভাবেই বসে রইল। তাদের কামরায় টিভি স্ত্রীনে ধ্বংসস্তুপের বর্ণনা দিয়ে একটি অনুষ্ঠান প্রচার করছে। অন্য সময় খুব আগ্রহ নিয়ে সে শুনতে, আজ শুনতে ইচ্ছে করছে না। কিভাবে টিভি সেটটি বন্ধ করা যায়, তাও তার জানা নেই। বাধ্য হয়ে শুনতে হচ্ছে। কী হবে শুনে। এর সবই তার জানা। ইতিহাসের ক্লাসে সে পড়েছে। খুব আগ্রহ নিয়েই পড়েছে। টিভির লোকটি বলছে খুব সুন্দর করে। আবেগ-আপুত কণ্ঠ। যেন ধ্বংস হবার ঘটনাটি সে প্ৰত্যক্ষ করছে।
বন্ধুগণ। ধ্বংসস্তুপের উপর দিয়ে আজ। আপনারা যারা ঝড়ের গতিতে যাচ্ছেন, তাদের মনে করিয়ে দিচ্ছি, আজ থেকে চারশ বছর আগে এখানে কোলাহল মুখর জনপদ ছিল। অঞ্চলটিকে বলা হত এশিয়া মাইনর।
আজ থেকে চার শ বছর আগে দু হাজার পাঁচ সালে পৃথিবী নামে আমাদের এই সুন্দর গ্রহটিতে নেমে এল ভয়াবহ দুৰ্যোগ, আণবিক যুগের শুরুতেই যে দুর্যোগের আশঙ্কা সবাই করছিল। শান্তিকামী মানুষ ভাবত, একসময় না একসময় আণবিক যুদ্ধ শুরু হবে। সেটিই হবে মানব জাতির শেষ দিন। দু হাজার পাঁচ সালে তাদের আশঙ্কাই সত্যি হল। তবে তারা যেভাবে ভেবেছিলেন, সেভাবে নয়। মানুষে-মানুষে, জাতিতে-জাতিতে যুদ্ধ হল না। কোনো এক অজানা কারণে জমা করে রাখা আণবিক অন্ত্রের বিস্ফোরণ শুরু হল। হাজার হাজার বছরের সভ্যতা ধ্বংস হতে সময় লাগল। মাত্র এগার মিনিট।
ধ্বংসযজ্ঞের পরবর্তী বছরকে বলা হয় অন্ধকার বছর। কারণ সে-বছর সূর্যের কোনো আলো পৃথিবীতে এসে পৌঁছল না। ধূলা-বালি, আণবিক ভস্ম সূর্যকে আড়াল করে রাখল। কাজেই ধ্বংস হল সবুজ গাছপালা। সবুজ গাছপালার উপর নির্ভরশীল জীবজন্তু। পরবতী এক শ বছরের তেমন কোনো ইতিহাস আমাদের জানা নেই। আমরা শুধু জানি অসম্ভব জীবনীশক্তি নিয়ে কিছু কিছু মানুষ বেঁচে রইল। তারা শুরু করল নতুন ধরনের জীবন-ব্যবস্থা। প্রথম শহর, দ্বিতীয় শহর ও তৃতীয় শহরভিত্তিক সমাজ-ব্যবস্থা। মানুষের ভবিষ্যৎকে সুনিশ্চিত করতে, সীমিত সম্পদের মধ্যেও তাদের সব রকম সুযোগ-সুবিধা দেবার জন্যে এই ব্যবস্থা ছাড়া অন্য কোনো ব্যবস্থার কোনো উপায় ছিল না।
প্রিয় বন্ধুগণ, এখন আপনাদের দু হাজার পাঁচ সালে সংঘটিত ভয়াবহ দুর্ঘটনার সম্ভাব্য কারণগুলো সম্পর্কে বলছি। এই কারণগুলোর কোনোটিই প্রমাণিত নয়। সবই অনুমান। প্রথম বলছি মহাজাগতিক রশ্মির প্রভাবে বিস্ফোরণ সংক্রান্ত হাইপোথিসিস।
এই পর্যায়ে টিভি পদ অন্ধকার হয়ে গেল। পরীক্ষণেই সেখানে ভেসে উঠল। অরচ লীওনের মুখ।
ইরিনা। এই ইরিনা।
বলুন।
একা-একা খেতে ভালো লাগছে না, তুমি চলে এস।
বললাম তো আমার খিদে নেই।
খিদে না লাগলে খাবে না। বসবে আমার সামনে। কিছু জরুরি কথা তোমাকে বলব।
বলুন, আমি শুনছি।
সামনাসামনি বসে বলতে চাই। তুমি কোথায় যােচ্ছ, এই সম্পর্কে তোমাকে কিছু ধারণা দেব।
অনেক বার আপনাকে জিজ্ঞেস করেছি, তখন তো কিছু বলেন নি।
এখন বলব। সব সময় সব কথা বলা যায় না। চলে এস। দেরি করো না।
টিভি পর্দায় আবার সেই আগের লোকটির মুখ ভেসে উঠল। সে একটি বোর্ডে কি-সব আকিছে এবং একঘেয়ে স্বরে বলছে- মহাজাগতিক রশ্মি বা কসমিক রে পৃথিবীতে আসে ওজোন স্তর ভেদ করে। ওজোন স্তর হচ্ছে মূলত অক্সিজেনের একটি রূপান্তরিত অণুর হালকা আস্তর। এই অণুগুলোর প্রতিটিতে আছে তিনটি করে অক্সিজেন পরমাণু-।
লোকটির কথা খুব একঘেয়ে লাগছে। ইরিনা উঠে পড়ল। সে খাবার গাড়িতেই যাবে। করিডোরে এ্যাটেনডেন্ট রোবট বলল, ইরিনা, তুমি কোথায় যাবে?
ইরিনা মোটেই চমকাল না। এই রোবটের কাজই হচ্ছে, ট্রেনের সাৰ কজন যাত্রীর খোঁজখবর রাখা। ইরিনা বলল, খাবার গাড়িতে যাব।
আমি কি তোমার সঙ্গে যাব?
দরকার নেই।
তুমি মনে হচ্ছে ট্রেন ভ্ৰমণ ঠিক উপভোগ করছ না।
না, করছি না।
খুবই দুঃখিত হলাম। ট্রেন ভ্ৰমণেকে আনন্দদায়ক করার জন্য আমি কি কিছু করতে পারি?
না।
রোবটটি সঙ্গে সঙ্গে আসছে। ইরিনার অস্বস্তি লাগছে। একটা যন্ত্র যখন মানুষের মতো কথা বলে, মানুষের মতো ভাবে, তখন অস্বস্তি লাগে।
ইরিনা, তুমি কি প্রথম শহরের নাগরিক?
হ্যাঁ, আমি প্রথম শহরের।
তোমাকে অভিনন্দন। খুব অল্প বয়সেই তুমি দ্বিতীয় শহরে ঢোকার অনুমতি পেয়েছি।
অভিনন্দনের জন্যে ধন্যবাদ। তুমি আমার সঙ্গে সঙ্গে আসছ কেন?
একটি কথা বলবার জন্যে আসছি। আমার মনে হয় কথাটা শুনলে তোমার ভালো লাগবে।
বল শুনছি।
তুমি অত্যন্ত রূপবতী।
ইরিনা শান্তস্বরে বলল, তোমাকে ধন্যবাদ।
আমি তোমাকে নিয়ে চার লাইনের একটা কবিতা লিখেছি। আমি খুব খুশি হব, কবিতাটি তুমি যদি গ্ৰহণ কর।
বেশ তো, দাও।
রোবটটি একটি কার্ড বাড়িয়ে দিল ইরিনার দিকে। তারপর বেশ লাজুক ভঙ্গিতেই তার জায়গায় ফিরে গেল। ইরিনা কবিতায় চোখ বুলাল–
আদৌ প্রেমের প্রয়োজন আছে কিনা
নিশ্চিত আজো হয় নি। আমার মন।
প্রেম থেকে তবু পৃথক করিয়া ঘৃণা
ভালোবাসিতেই চেয়েছি সৰ্বক্ষণ।।
ইরিনা লক্ষ করল, তার মন ভালো হয়ে যাচ্ছে। একটু যেন খিদেও পাচ্ছে। হালকা ধরনের কোনো খাবার খাওয়া যেতে পারে।
ইরিনা নিঃশব্দে খাচ্ছে।
অরচ লীওন হাসিমুখে তা লক্ষ করছেন। তার হাতে এক মগ ঝাঁঝালো ধরনের পানীয়, অবসাদ দূর করতে যার তুলনা নেই।
ইরিনা।
বলুন।
এখানকার খাবারগুলো কেমন?
ভালো।