বাইরে বেশ ঠাণ্ডা। কনকনে বাতাস বইছে। একটা ভারি জ্যাকেট ইরিনার গায়ে। লাল রঙের মাফলারে কান ঢাকা, তবু তার শীত করছে। রাস্তাঘাটে লোকজন দ্রুত কমছে। রাত আটটার ভেতর একটি লোকও থাকবে না। থাকার নিয়ম নেই। ফেডারেল আইন। বেরুতে হলে কমিউন থেকে পাস নিতে হয়। সেই পাস কখনো পাওয়া যায় না। রাতে কেউ গুরুতর অসুস্থ হলে ডাক্তার এসে চিকিৎসা করেন, তাকে হাসপাতালে যেতে হয় না। তবু মাঝেমধ্যে কেউ কেউ বের হয়। তারা আর ফিরে আসে না। কোথায় হারিয়ে যায় কে জানে?
তোমার শীত লাগছে ইরিনা?
না।
তুমি কিন্তু কাঁপছ?
আমার শীত লাগছে না।
তুমি কিন্তু এখনো আমার নাম জানতে চাও নি।
আপনার নাম দিয়ে আমার কোনো প্রয়োজন নেই।
তা খুবই ঠিক। তোমার বয়স কত ইরিনা?
ইন্টলিজেন্সের লোক যখন কারো কাছে আসে, তখন তার নাম এবং বয়স জেনেই আসে।
ঠিক। খুবই সত্যি কথা। তোমার বয়স এপ্রিলের তিন তারিখে আঠার হবে।
ইরিনা হঠাৎ রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে কঠিন গলায় বলল, আপনি আর কী কী জানেন আমার সম্বন্ধে?
তুমি লাল ও বেগুনি- এই দুটি রঙ খুব পছন্দ করা। তোমার কোনো বন্ধুবান্ধব নেই। তোমার পছন্দের বিষয় হচ্ছে প্রাচীন ইতিহাস। তুমি এই বিষয়ে প্রচুর পড়াশোনা করেছি। তুমি খুব শান্ত স্বভাবের মেয়ে এবং তুমি…
থাক, আপনাকে আর কিছু বলতে হবে না।
লোকটি হাসতে লাগল। যেন বেশ মজা পেয়েছে। সিকিউরিটির একটি গাড়ি তাদের সামনে এসে থামল, কিন্তু লোকটির হাসি বন্ধ হল না। গাড়ি থেকে দুজন অফিসার লাফিয়ে নামল। দুজনের চেহারাই সুন্দর। চকলেট রঙের ইউনিফর্মেও তাদের ভালো লাগছে।
আপনাদের সন্ধ্য পাস দেখতে চাই।
এখনই সন্ধ্য পাস দেখতে চান? আটটা এখনো বাজে নি। আটটা বাজতে দিন।
অফিসার দুজনে মুখ কঠোর হয়ে গেল। সে তাকাল তার সঙ্গীর দিকে। সঙ্গী তীক্ষ্ণ গলায় বলল, যা করতে বলা হয়েছে, করুন।
ইরিনা দেখল ইন্টেলিজেন্সের লোকটি ওদের দুজনকে কী যেন দেখাল। সঙ্গে সঙ্গে অফিসার দুজনেই হকচাকিয়ে গেল। এক জনের মুখ অনেকখানি লম্বা হয়ে গেল। সে টেনে টেনে বলল, স্যার, আপনারা কোথায় যাবেন বলুন, আমরা পৌঁছে দেব।
আমার হাঁটতে ভালো লাগছে।
তাহলে আমরা কি আপনার পেছনে পেছনে আসব?
তারাও কোনো প্রয়োজন দেখছি না।
ইরিনা লক্ষ করল, লোক দুটির মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। যেন তারা চোখের সামনে ভূত দেখছে। একজন পকেট থেকে রুমাল বের করে এই শীতেও কপালেরর ঘাম মুছল। ইরিনা অনেক দূর এগিয়ে যাবার পর পেছন ফিরে দেখল, অফিসার দুজন তখনাে দাঁড়িয়ে এক দৃষ্টিতে তাদের দেখছে। একজন ওয়াকিটকি বের করে কী যেন বলছে। সম্ভবত তাদের কথাই বলছে। কারণ এরপর বেশ কিছু সিকিউরিটির লোকজনের সঙ্গে দেখা হল। তারা কেউ কোনো প্রশ্ন করল না। স্যালিউট দিয়ে মূর্তির মতো হয়ে গেল। ইরিনার সঙ্গের লোকটি প্রত্যেকের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলল। যেমন—
কি, তোমরা ভালো? আজি বেশ শীত পড়েছে মনে হয়। আবহাওয়ার প্যাটার্ন বদলে যাচ্ছে, তাই না?
এরা এইসব কথাবাতাঁর উত্তরে কিছু বলছে না। শুধু মাথা নাড়ছে। যেন কথা বলাই একটা ধৃষ্টতা। ইরিনা একসময় বলল, ওরা আপনাকে দেখে এরকম করছে কেন?
তোমাকে তো বলেছি আমি একজন বিখ্যাত ব্যক্তি।
আপনার কী নাম?
তুমি একটু আগেই বলেছি, আমার নাম জানতে তুমি আগ্রহী নও। কি বল নি এমন কথা?
বলেছি।
এখন কেন নাম জানতে চাও?
আপনার যদি ইচ্ছা হয় বলতে পারেন।
ইচ্ছা-অনিচ্ছা নয়, তুমি জানতে চাও কিনা সেটা বল।
না থাক, আমি জানতে চাই না।
আমার নাম অরচ লীওন।
ইরিনা সঙ্গে সঙ্গে চিনতে পারল। অরচ লীওন হচ্ছেন গ্যালাকটিক ইন্টেলিজেন্সের প্রধান। তার নাম না জানার কোনো কারণ নেই। এরকম একজন মানুষ তার মতো সাধারণ একটি মেয়েকে নিতে এসেছেন, কেন?
ইরিনা, তোমার কি হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে?
না, কষ্ট হচ্ছে না।
শীল লাগছে, তাই না?
জি লাগছে।
এই তো এসে পড়েছি। ট্রেনে উঠলেই দেখবে ভালো লাগছে।
ভালো লাগলেই ভালো।
আর একটা গল্প বলব, শুনবে?
বলুন।
তারা শহরের শেষ প্রান্তে এসে পড়েছে। স্টেশনের লাল বাতি দেখা যাচ্ছে। বাতি জুলছে ও নিভছে। চারদিকে নীরব-নিস্তব্ধ। কুয়াশা ঘন হয়ে পড়েছি। ইরিনা ফিসফিস করে বলল, আমি চলে যাচ্ছি, আর কোনো দিন ফিরে আসব না।
ট্রেন ছুটে চলেছে
ট্রেন ছুটে চলেছে।
গতি একশ কিলোমিটারের কাছাকাছি। আলট্রাভায়োলেট প্রতিরোধী স্বচ্ছ কাচের জানালার পাশে ইরিনা বসে আছে। বাইরের পৃথিবীর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। অরচ লীওন বললেন, তুমি বোধ হয় এই জীবনের প্রথম ট্রেনে চড়লে।
হ্যাঁ। আমি প্রথম শহরের মানুষ। ট্রেনে চড়ার সৌভাগ্য আমার হবে কেন?
তা ঠিক। কেমন লাগছে তোমার?
কোনোরকম লাগছে না।
জানালার পাশে বসে কিছুই দেখতে পাবে না। বাইরে আলো নেই। এখন কৃষ্ণপক্ষ। অবশ্যি চাঁদ থাকলেও কিছু দেখতে পেতে না, আমরা যাচ্ছি। ধ্বংসস্তুপের মধ্যে দিয়ে। আমাদের প্রায় এক হাজার কিলোমিটার ধ্বংসস্তুপের ভেতর দিয়ে যেতে হবে। সেটা খুব সুখকর দৃশ্য নয়। এই জন্যেই ধ্বংসস্তুপের ভেতর দিয়ে যেসব ট্রেন চলাচল করে, তা করে রাতে, যাতে আমাদের কিছু দেখতে না হয়।
আপনি শুধু শুধু কথা বলবেন না। আপনার কথা শুনতে ভালো লাগছে না।
খাবার দিতে বলি?
না।
কিছু খাবে না?
না, আমার খিদে নেই।
আমার খিদে পেয়েছে। আমি খাবার গাড়িতে যাচ্ছি। তুমি যদি মত বদলাও তাহলে চলে এস। করিডোর ধরে আসবে, সবচে শেষের কামরাটি খাবার ঘর। রোবট এ্যাটেনডেন্ট আছে। ওদের বললে ওরা তোমাকে সাহায্য করবে।