ভালো লাগছে না, কিছু ভালো লাগছে না।
তিনি দ্রুত পাতা ওল্টাতে লাগলেন। যেন কোনো বিশেষ লেখা খুঁজছেন। তাঁর ভুরু কুঞ্চিত হতে থাকল। ইদানীং তিনি অল্পতেই ধৈৰ্য হারিয়ে ফেলেন, আজ তা হল না। শান্ত ভঙ্গিতেই পাতা ওল্টাচ্ছেন, যদিও তাঁর ভুরু কুঞ্চিত। যা খুঁজছিলেন পেয়ে গেলেন— একটি অংশ যা সাংকেতিক ভাষায় লেখা নয়। তারিখ দেয়া নেই সময় দেয়া নেই। তবে তার মানে আছে, একদিন খুব ভোর বেলায় হঠাৎ কি মনে করে যেন তিনি লিখলেন,
আমার মনে হচ্ছে ওরা আমাদের সহ্য করতে পারছে না। এরকম মনে করার কোনো যুক্তিগ্রাহ্য কারণ নেই। একদল যন্ত্র কেন আমাদের অপছন্দ করবে? তাছাড়া পছন্দ-অপছন্দ ব্যাপারটি যন্ত্রের থাকার কোনো কারণ নেই। রিবেত্ৰি সার্কিট ব্যবহার করা হলেও ওরা রোবট-এর বেশি কিছু নয়। যা বললাম তা কি ঠিক? সত্যি কি এরা রোবটের বেশি কিছু নয়? আমি এ ব্যাপারেও পুরোপুরি নিশ্চিত নই। মনে হচ্ছে কোনো গোপন রহস্য আছে। সেই রহস্য আমি ধরতে পারছি না।
তিনি সুইচ টিপলেন, লাল আলো নিভে গেল। তিনি ক্লান্ত গলায় ডাকলেন, সিডিসি।
বলুন শুনছি।
তুমি কেমন আছ?
আমি ভালোই আছি। আমার ভালো থাকা তো আর আপনাদের মতো নয়। আমি ভালো আছি আমার নিজের মতো।
রোবটিকস-এর গবেষণা কেমন চলছে?
ভালোই চলছে। বর্তমানে এমন এক ধরনের রোবট তৈরির চেষ্টা চলছে। যা হাসি, তামাশা, রসিকতা এইসব বুঝতে পারবে।
রসিকতা বুঝতে পারে এমন রোবটের দরকার কি?
মানুষের সঙ্গে সুসম্পর্কের জন্যে এটা খুব দরকার।
তার মানে?
মানুষরা রসিকতা খুব পছন্দ করে। কথায় কথায় রসিকতা করে। ওদের রসিকতা আমরা কখনো বুঝতে পারি না।
তাতে কি তোমাদের কোনো ক্ষতি হচ্ছে?
কোনো ক্ষতি হচ্ছে না। তবে তারা যখন কোনো রসিকতা করে এবং আমরা তা বুঝতে পারি না, তখন নিজেদের খুব ছোট মনে হয়।
তিনি চমকে উঠলেন। কী ভয়াবহ কথা! এটা তিনি কী শুনছেন? নিজেদের ছোট মনে হয়-এর মনে কী? এসব মানবিক ব্যাপার রোবট এবং কম্পিউটারের মধ্যে থাকবে কেন? রহস্যটা কি?
সিডিসি।
বলুন, শুনছি।
অরচ লীওন লোকটিকে এখানে নিয়ে এস।
আপনার এই ঘরে?
হ্যাঁ এই ঘরে।
কেন?
আনতে বলছি। এই কারণেই আনবে। প্রশ্ন করবে না।
সিডিসি বলল, আপনি ঠিক সুস্থ নন। আপনি বিশ্রাম করুন।
তোমাকে যা করতে বলছি কর।
বেশ, নিয়ে আসছি।
অমর মানুষেরা এখন কি করছেন?
ঘুমুচ্ছেন।
সবাই ঘুমুচ্ছেন?
হ্যাঁ, সবাই ঘুমুচ্ছেন। ওদের ঘুম ভাঙান যাবে না। দীর্ঘ ঘুম। শারীরিক ও মানসিক দিক দিয়ে তাঁরা ক্লান্ত। তাদের ঘুম প্রয়োজন। খুবই প্রয়োজন।
আমি তাহলে একাই জেগে আছি?
জি। আপনি একাই আছেন।
খুব ভালো। তুমি অরচ লীওনকে এখানে আনার ব্যাবস্থা কর। তার সঙ্গে কথা বলব।
অরচ লীওন থরথর করে কাঁপছেন
অরচ লীওন থরথর করে কাঁপছেন। তার সামনে অমর মানুষদের একজন বসে আছে। মহাশক্তিধর, মহাক্ষমতাবানদের একজন। পৃথিবীর নিয়ন্তা। পুরনো কালের ঈশ্বরের মতোই একজন। কী অপূর্ব রূপবান একটি যুবক!
বস, অরচ লীওন। তুমি কি আমাকে ভয় পাচ্ছ?
জ্বি পাচ্ছি।
আমাকে দেখে কি ভয়াবহ মনে হচ্ছে?
জ্বি না।
তাহলে ভয় পাচ্ছি কেন? আরাম করে বস।
অরচ লীওন বসলেন। পানির তৃষ্ণায় তাঁর বুক ফেটে যাচ্ছে। মাথা ঘুরছে। মনে হচ্ছে কিছুক্ষণের মধ্যেই জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যাবেন। নিজেকে সামলাতে তার কষ্ট হচ্ছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম, যদিও এই ঘর বেশ ঠাণ্ডা। তাঁর রীতিমতো শীত করেছে। অমর মানুষরা গরম সহ্য করতে পারেন না। তাঁদের প্রতিটি কক্ষই হিমশীতল।
অরচ লীওন!
বলুন জনাব।
তুমি আমাদের ব্যাপারে উৎসাহী হয়েছিলে। অনুসন্ধান শুরু করেছিলে। উৎসাহের শুরুটা আমাকে বল। হঠাৎ কী কারণে উৎসাহী হলে?
তিনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অরচ লীওনকে দেখছেন। ঘরে লাল আলো জুলছে। সিডিসির সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। তাদের মধ্যে যে কথা হবে তা তৃতীয় কোনো ব্যক্তি বা যন্ত্র শুনবে না।
চুপ করে বসে আছ কেন? বল।
একদিন লাইব্রেরিতে দাবা খেলার একটা বইয়ের জন্য স্লিপ পাঠিয়েছিলাম। লাইব্রেরি ভুল করে অন্য একটা বই দিয়ে দিল। একটা নিষিদ্ধ বই। পাঁচ শবছর আগের পৃথিবীর কথা সেই বইয়ে আছে। একদল বিজ্ঞানীর কথা আছে, যাদের বলা হয়। ভূগর্ভস্থ বিজ্ঞানী। ওদের অনেক কথা সেই বইয়ে আছে।
দু-একটা কথা বল শুনি।
ভূগর্ভস্থ বিজ্ঞানীদের কাজ পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা ঠিক পছন্দ করছেন না, এইসব কথা আছে। পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা বলছেন, বিজ্ঞান কোনো গোপন বিষয় নয় যে এর কাজ গোপনে করতে হবে। ভূগর্ভস্থ বিজ্ঞানীরা বলছেন, বিজ্ঞানের অসীম ক্ষমতা। এই ক্ষমতার বিকাশ গোপনেই হওয়া উচিত। হাতছাড়া হয়ে গেলে পৃথিবীর মহা বিপদ। এই সব বিতর্ক নিয়েই বই।
অরচ লীওন।
জ্বি জনাব।
তুমি দাবা খেলার ওপর একটি বই চেয়েছ, তোমার হাতে চলে এসেছে একটি নিষিদ্ধ বই। তোমার কি একবারও মনে হয় নি এই ভুলটি ইচ্ছাকৃত?
না, মনে হয় নি। লাইব্রেরি পরিচালক একটি ছোট বি টু-কম্পিউটার। কম্পিউটার মাঝে মাঝে ভুল করে।
এত বড় ভুল করে না।
ভুল হচ্ছে ভুল। এর বড়ো ছোট বলে কিছু নেই।
এটি নিষিদ্ধ নগরীর বই। এই বই তৃতীয় শহরের কোনো লাইব্রেরিতে থাকার কথা নয়।
অরচ লীওন চুপ করে রইলেন। রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছলেন। তৃষ্ণায় তাঁর বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছে। পানি চাইবার মতো সাহস তিনি সঞ্চয় করে উঠতে পারছেন না।