এই মেয়ে।
ইরিনা চমকে উঠল। নিজেকে খুব সহজেই সামলে নিল। পা গুটিয়ে মীর বসে আছে। আর মুখভর্তি হাসি। মীর বলল, তোমাকেও এখানে এনে ফেলে দিয়েছে নাকি? তুমিও এলে?
দেখতেই তো পাচ্ছেন, আবার জিজ্ঞেস করছেন কেন?
আরো আস্তে কথা বল। শব্দ করে বললে বিকট প্ৰতিধ্বনি হয়। যা বলার কানের কাছে মুখ এনে বল।
আমার কিছু বলার নেই।
আরো কি মুশকিল। আমার ওপর রাগ করছ, কেন? আমি তো তোমাকে গুহায় এনে ফেলি নি।
আপনি এখানে বসে বসে কী করছেন?
তোমার জন্যে অপেক্ষা করছি। যে জায়গায় বসে আছি সেটা হচ্ছে কেন্দ্ৰবিন্দু। তোমাকে এখানে আসতেই হবে।
আমি যে এখানে আছি, কী করে বুঝলেন? আপনাকে ওরা বলেছে?
আরে না। কিছুই বলে নি। নিজের ঘরে ঘুমুচ্ছিলাম, হঠাৎ জেগে উঠে দেখি এখানে শুয়ে আছি। কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে বুঝলাম এটা একটা গোলকধাঁধা। বেশ মজা লাগল। ঘণ্টাখানেক আগে তোমার গলা শুনলাম, তারপর থেকেই তোমার জন্যে অপেক্ষা করছি।
ইরিনা বলল, আপনি তো একবার বলেছিলেন যে আপনি খুব বুদ্ধিমান। এখান থেকে বেরুতে পারবেন?
আরে এই মেয়ে কি বলে? পারব না কেন? ব্যাপারটা খুব সোজা। তোমাকে যে কোনো একদিকে বাক নিতে হবে। হয় ডানে যাবে না বা দিকে যাবে। তাহলেই হল। তবে এমনিতে ডান-বাম ঠিক রাখা মুশকিল, কাজেই সবচেয়ে ভালো বুদ্ধি হচ্ছে ডান হাতে ডান দিকের দেয়াল ছুঁয়ে যাওয়া।
আপনি গিয়েছিলেন?
নিশ্চয়ই। গোলকধাঁধার রহস্য পাঁচ মিনিটের মধ্যে বের করেছি।
সত্যি কি করেছেন?
আরো কী মুশকিল! আমি তোমার সঙ্গে মিথ্যে কথা বলব কেন? বস এখানে। গল্প করি।
গল্প করবেন? আচ্ছা, আপনি কি পাগল?
মীর অত্যন্ত অবাক হল। এই মেয়েটির রাগের কোনো কারণ তার মাথায় ঢুকছে না। রাগ হলেও হওয়া উচিত, যারা মেয়েটিকে এখানে এনেছে তাদের ওপর। সে তো তাকে এখানে আনে নি। মীর দ্বিতীয়বার বলল, বস ইরিনা। কেন শুধু শুধু রাগ করছ?
ইরিনা তাকে অবাক করে দিয়ে সত্যি সত্যি বসল। হালকা গলায় বলল, মনে হচ্ছে আপনি খুব সুখে আছেন?
সুখেই তো আছি।
কেন সুখে আছেন জানতে পারি?
সুখে আছি, কারণ এই প্রথম নিজের মতো করে থাকতে পারছি। যেসব প্রশ্ন করামাত্র প্রথম শহরে লোকদের শাস্তি হয়ে যায়। সেই সব প্রশ্ন করতে পারছি এবং জবাবও পাচ্ছি।
আর এই যে একটা ছোট্ট ঘরে আপনাকে দিনের পর দিন বন্ধ করে রাখা হয়েছে, তার জন্যে খারাপ লাগে না?
না তো। চিন্তা করবার মতো কত কি পাচ্ছি। চিন্তা করে করে কত রহস্যের সমাধান করে ফেললাম।
তাই বুঝি।
মীর আহত গলায় বলল, আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না? কয়েক দিন আগে একটা রহস্য ভেদ করলাম। সেই কথা শুনলে তুমি অবাক হবে। যেমন ধর, অমর মানুষদের সংখ্যা এখন নয়জন। এক সময় ছিল চল্লিশ জন। তাদের মধ্যে পুরুষও ছিলেন এবং রমণীও ছিলেন। তবু সংখ্যা বাড়ল না। এর মানে কি? এর মানে হচ্ছে অমর মানুষদের ছেলেপুলে হয় না।
এইটাই আপনার বিশাল আবিষ্কার?
আবিষ্কারটা খুব ক্ষুদ্র, এ-রকম মনে করারও কারণ নেই। ভালোমত ভেবে দেখ, অমর মানুষরা বংশ বৃদ্ধি করতে পারেন না, এবং তাদের সংখ্যা কমছে। অর্থাৎ তারা অমর নন।
ইরিনা তাকিয়ে আছে। মীর উজ্জ্বল চোখে হড়বড় করে কথা বলে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে তার আনন্দের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। ইরিনার মনে হল, এই লোকটি কী নির্বোধ! একমাত্র নির্বোধরাই এমন অবস্থায় এত হাসিখুশি থাকতে পারে।
মীর হাত নেড়ে বলল, নিষিদ্ধ নগর জায়গাটা কোথায় বল তো?
ইরিনা তাকিয়ে রইল, উত্তর দিল না। মীর বলল, জায়গাটা মাটির ওপরে না নিচে, এইটা বল।
মাটির নিচে হবে কেন? এই ব্যাপারটাই আমাকে খটকায় ফেলে দিয়েছে। মাটির নিচে কেন? কারণটা আমি বের করেছি।–
কারণ পরে শুনব, আগে বলুন জায়গাটা মাটির নিচে বলে ভাবছেন কেন?
জায়গাটা মাটির নিচে বলে ভাবছি, কারণ এখানে বাতাস বইতে লক্ষ করি নি। সারাক্ষণই বাতি জুলছে এবং এখানকার তাপমাত্রা সব সময় সমান থাকে। কোনো হ্রাস-বৃদ্ধি নেই।
মাটির ওপরেও তো এরকম একটা ঘর থাকতে পারে। বিশাল একটি ঘরের ভেতর দিয়ে ঘরাও তো এরকম হতে পারে। পারে না?
হ্যাঁ তা অবশ্যি পারে, তুমি ঠিকই বলেছ। আমারও এরকম সন্দেহ হয়েছিল, কাজেই আমি খুব বুদ্ধিমানের মতো একটি প্রশ্ন করে এনারোবিক রোবটের কাছ থেকে উত্তরটা বের করে ফেললাম।
কি প্রশ্ন?
আমি জিজ্ঞেস করলাম, জায়গাটা মাটির নিচে না ওপরে? সে বলল, नि5। श श श।
ইরিনা হাসবে না। কাঁদবে বুঝতে পারল না। কি বিচিত্ৰ মানুষ! ইরিনা বিরক্ত হয়ে বলল, শুধু শুধু এত হাসছেন কেন?
হাসছি, কারণ এত চিন্তা-ভাবনা করে এই জিনিসটা বের করার দরকার ছিল না রোবটকে জিজ্ঞেস করলেই হত। হা হা হা।
হাসবেন না। আপনার হাসি শুনতে ভালো লাগছে না।
প্রথম দুদিন এরা নিষিদ্ধ নগর নিয়ে কোনো প্রশ্ন করলে উত্তর দিত না। এখন যা জানতে চাই বলে দেয়। এর মানেটা কি বল তো?
জানি না।
এর মানে হচ্ছে ওরা আমাদের মেরে ফেলবে। মরবার আগে একটু ভালো ব্যবহার করছে। হা হা হা।
আমাদের মেরে ফেলবে, এটা কি খুব আনন্দের ব্যাপার? এ রকম করে হাসছেন কেন?
কী করতে বল আমাকে? পা ছড়িয়ে বসে বসে কাঁদব?
ইরিনা চুপ করে আছে। মীর শান্ত গলায় বলল, আমাদের কিছুই করার নেই। শুধু চিন্তা করে লাভ কি? এর চেয়ে আনন্দে থাকাটাই কি ভালো না? কি, কথা বলছ না কেন?