ইরিনা হিটারে পানি গরম করত লাগল। তার একবার ইচ্ছা হল রান্নাঘরের দরজা দিয়ে চুপিসারে চলে যায় কোথাও। কিন্তু তা সম্ভব হয়। এ রকম কিছু চিন্তা করাও বোকামি।
টেলিফোন বাজছে। ইরিনা তাকাল লোকটির দিকে। ঠাণ্ডা গলায় বলল, আমি কি টেলিফোন ধরতে পারি?
হ্যাঁ পার।
টেলিফোন করেছেন ইরিনার বাবা। তার গলায় বারবার কথা আটকে যাচ্ছে। যেন কোনো কারণে তিনি অসম্ভব ভয় পেয়েছেন। কথার ফাঁকে ফাকে এবড় বড় করে শ্বাস ফেলছেন।
তুমি কোথেকে কথা বলছি বাবা?
খাদ্য দপ্তর থেকে ৷
তুমি কিছু বলবে?
না।
শুধু শুধু টেলিফোন করেছ?
ইয়ে মা শোন— আমাকে কোথায় যেন পাঠাচ্ছে।
কোথায় পাঠাচ্ছে?
তা তো জানি না। অনেকক্ষণ শুধু শুধু বসিয়ে রাখল। এখন বলছে-
কী বলছে?
ইরিনার বাবা খট করে টেলিফোন নামিয়ে রাখলেন। যেন কাউকে দেখে ভয় পেয়েছেন। অনেক কিছু বলার ছিল, বলা হল না। ইরিনা টেলিফোনের ডায়াল ঘোরাচ্ছে। লোকটি তার দিকে তাকিয়ে হালকা স্বরে বলল, কোনো লাভ নেই, কেউ টেলিফোন ধরবে না। সত্যি কেউ ধরল না। ইরিনার কাঁদতে ইচ্ছা! হচ্ছে, কিন্তু এই কুৎসিত লোকটিকে চোখের জল দেখাতে ইচ্ছা করছে না। কান্না চেপে রাখা খুব কঠিন ব্যাপার। এই কঠিন ব্যাপারটি সে কী করে পারছে কে জানে। কতক্ষণ পারবে তাও জানা নেই।
পানি ফুটছে। কফি বানিয়ে ফেল। চিনি বেশি করে দেবে। আমি প্রচুর চিনি খাই। বুদ্ধিমান লোকেরা চিনি বেশি খায়, এই তথ্য কি তুমি জান?
ইরিনা জবাব দিল না।
লোকটি কফি খেল নিঃশব্দে। তার ধরনধারণ দেখে মনে হয়, কোনো তাড়া নেই। দীর্ঘ সময় চুপচাপ বসে থাকতে পারবে। কফি শেষ করেই সে তার নীল ব্যাগ থেকে কি-একটা বই বের করে পড়তে শুরু করল। বইয়ের লেখাগুলো অদ্ভুত, নিশ্চয়ই কোনো অপরিচিত ভাষা। লোকটি পড়তে পড়তে মুচকি মুচকি হাসছে। নিশ্চয় মজার কোনো বই। একটি লোহার রড হাতে নিয়ে চুপিচুপি লোকটির পেছনে চলে গেলে কেমন হয়। আচমকা প্ৰচণ্ড বেগে লোহার রডটি তার মাথায় বসিয়ে দেবে। ইরিনা মনে মনে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল। এই রকম কল্পনার কোনো মানে হয় না।
লোকটি হাতের ঘড়িতে সময় দেখল। বইটি বন্ধ করে নীল ব্যাগে রেখে বলল, সন্ধ্যা সাড়ে ছাঁটায় আমাদের ট্রেন। কাজেই অনেকখানি সময় আছে। রাতে খাওয়া-দাওয়া আমরা ট্রেনেই সারব। কাজেই রান্নাবান্নার জন্যে তোমাকে ব্যস্ত হতে হবে না। তুমি যদি সঙ্গে কিছু নিতে চাও, নিতে পাের। একটা মাঝারি ধরনের সুটকেস গুছিয়ে নাও।
আমরা কোথায় যাচ্ছি?
বিধি চ ২১১/৩; আমাকে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না।
ইরিনা চুপ করে গেল। একবার ইচ্ছা হল গলা ফাটিয়ে কাদে। কিন্তু কী হবে কেন্দে? কে শুনবে?
তুমি কি সঙ্গে কিছুই নেবে না?
না।
খুব ভালো কথা। ভ্রমণের সময় মালপত্র যত কম থাকে, ততই ভালো। সবচে ভলো যদি কিছুই না থাকে। হা হা হা।
ইরিনা বলল, আমি কোনো অন্যায় করি নি। দুই শ পঞ্চাশটি বিধির প্রতিটি মেনে চলি। শৃঙ্খলা বোর্ড একবারও আমাকে সাবধান কার্ড পাঠায় নি। আপনি কেন শুধু শুধু আমাকে নিয়ে যাচ্ছেন?
তুমি প্রতিটি বিধি মেনে চল, এটা ঠিক বললে না। এই মুহুর্তে তুমি বিধি ভঙ্গ করেছ। আমাকে প্রশ্ন করেছ।
আর করব না।
এই তো লক্ষ্মী মেয়ের মতো কথা। কাদছ কেন তুমি?
আমি কাঁদতেও পারব না? বিধিতে কিন্তু কাঁদতে পারব না, এমন কথা নেই।
তা নেই। তবে কাঁদলেই লোকজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হবে। আমি তা চাই না। আমি চাই খুব সহজ এবং স্বাভাবিক ভঙ্গিতে তুমি আমার সঙ্গে হাঁটবে। আমি চমৎকার সব হাসির গল্প জানি। সেই সব গল্প তোমাকে পথে যেতে যেতে বলল। শুনে হাসতে হাসতে তুমি আমার হাত ধরে হাঁটবে।
ইরিনা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, দয়া করে বলুন, আমি কি করেছি।
লোকটি শান্ত গলায় বলল, আমি জানি না তুমি কি করেছ। সত্যি আমি জানি না। আমাকে শুধু বলা হয়েছে তোমাকে নিয়ে যেতে।
কোথায়?
সেটা তোমাকে বলতে পারব না। তবে এইটুকু বলতে পারি যে, তুমি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষ। আমি ঠিক গুছিয়ে বলতে পারছি না। সহজ কথায় তুমি অত্যন্ত মূল্যবান।
কী করে বুঝলেন?
তোমাকে ন্যার জন্য আমকাএ পাঠান হয়েছে, সেই কারনেই অনুমান করছি। আমি কোনো হেঁজিপোঁজি ব্যক্তি নই, আমি একজন বিখ্যাত ব্যক্তি।
আমাকে এইসব কেন বলছেন?
যাতে অকারণে তুমি ভয় না পাও, সেজন্যে বলছি। তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে। ঠিক তোমার মতো আমার একটি মেয়ে আছে। তার চোেখও নীল। সে-ও তোমার মতো সুন্দর।
আপনি মিথ্যা কথা বলছেন। আপনার কোনো মেয়ে নেই। কেউ মিথ্যা বললে আমি বুঝতে পারি। মিথ্যা বলার সময় মানুষের চোখের দৃষ্টি বদলে যায়।
তুমি ঠিকই বলেছ। আমার কোনো ছেলেমেয়ে নেই। আমি অবিবাহিত।
ইরিনা শান্ত স্বরে বলল, আপনি কি দয়া করে বলবেন, আমার বাবা-মা এ বাড়িতে ফিরে আসবেন কি না?
আমার মনে হয়, তারা আর ফিরে আসবে না।
ঘরে তালা লাগানোর তাহলে আর কোনো প্রয়োজন নেই, তাই না?
আমার মনে হয়, নেই।
আমি নিজেও বোধ হয়। আর কোনোদিন এ বাড়িতে ফিরে আসব না।
সেই সম্ভাবনাই বেশি।
চলুন আমরা রওনা হই।
আমার হাত ধর।
ইরিনা তার হাত ধরল। লোকটি বিনা ভূমিকায় একটা হাসির গল্প শুরু করল। লোকটির গল্প বলার ঢং অত্যন্ত চমৎকার। ইচ্ছা না করলেও শুনতে হয়। একজন মানুষ কী করে হঠাৎ একদিন ছোট হতে শুরু করলো সেই গল্প। ছোট হতে হতে মানুষটা একটা পিপড়ের মতো হয়ে গেল। তার চিন্তা-ভাবনাও হয়ে গেল পিপড়ের মতো। বড়ো কিছু এখন সে আর ভাবতে পারে না।