যাই হোক, আবার ম্যাপ দেখা হল। গভীর আলোচনা হল। আবার শুরু করা গেল। লাভ হল না। সাত মিনিট যেতেই রুটির টুকরোর কাছে তারা ফিরে এল। এর পর থেকে এমন হল, এরা কোথাও যেতে পারে না। রাওয়ানা হওয়া মাত্র রুটির টুকরোর কাছে ফিরে আসে। ব্যাপারটা এতই স্বাভাবিকভাবে ঘটতে লাগল যে কেউ কেউ ক্লান্ত হয়ে রুটির টুকরোটির কাছে অপেক্ষা করে, কারণ তারা জানে সাবই এই জায়গাতেই ফিরে আসবে। আসছেও তাই। ভয়াবহ ব্যাপার…।
গল্পের এ জায়গা পর্যন্ত এসেই ইরিনা হাসিতে ভেঙে পড়ল। আর যেন এগোতে পারছে না। একটু পড়ে, আবার হাসে। আবার পড়ে, আবার হাসে। যে জায়গায় গোলকধাঁধার পরিদর্শক এসেছেন তাদের উদ্ধার করতে এবং তিনিও সব গুলিয়ে ফেলেছেন, সেই অংশ পড়তে ইরিনার হিস্টিরিয়ার মতো হয়ে গেল। হাসতে হাসতে চোখে পানি এসে গেছে। বিস্মিত হয়ে দেখছে এনারেবিক রোবট।
ইরিনা।
বল।
আমরা হ্যাম্পটন কোর্টের গোলকধাঁধার মতো একটা গোলকধাঁধা। এখানে তৈরি করেছি।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। তবে আমাদের এই গোলকধাঁধা তার চেয়ে কিছু জটিল।
ভেতরে ঢুকলে হ্যারিসের মতো আটকে যাব? বেরুতে পারব না?
মনে হচ্ছে তাই, তবে যদি বুদ্ধিমান হও, তাহালে নিশ্চয়ই বেরুতে পারবে।
ভালো কথা, এখন তুমি চলে যাও। আমি এই বইটা পড়ব। এই জাতীয় বই তুমি আমাকে আরো জোগাড় করে দেবে।
তোমার ধারণা এটা খুব একটা মজার বই?
ধারণা নয়। আসলেই এটা একটা মজার বই।
ইরিনা।
বল।
আমরা পরিকল্পনা করেছি। তোমাকে আমাদের তৈরি গোলকধাঁধায় ছেড়ে দেব।
তার মানে?
আমি দেখতে চাই তুমি কী করা। তোমার মানসিক অবস্থাটা আমরা পরীক্ষা করব। ঐ পরিস্থিতিতে তুমি কী কর আমরা দেখব। বেরুবার পথ খুঁজে না পেলে তোমার মানসিক অবস্থাটা কী হয়, তাই আমাদের দেখার ইচ্ছা।
ইরিনা তাকিয়ে আছে। এনারোবিক রোবটটি বলল, এক দিকের প্রবেশপথ দিয়ে তোমাকে ড়ুকিয়ে দেব, অন্য দিকের প্রবেশপথ দিয়ে ঢুকিয়ে দেব মীরকে।
কেন?
এই প্রশ্নের উত্তর তো একবার দিয়েছি। ক্ষুদ্র একটা পরীক্ষা আমরা করছি। আমরা মনে করি মানবিক আবেগ বোঝার জন্যে এই পরীক্ষাটি কাজে দেবে। আমরা অনেক নতুন নতুন তথ্য পাব।
এই জাতীয় পরীক্ষা কি তোমরা আগেও করেছ?
হ্যাঁ, করা হয়েছে। তুমি তো ইতোমধ্যেই জেনেছ, প্রথম শহরের কিছু নাগরিককে এখানে আনা হয়। অমর মানুষরা তাদের সঙ্গে কথা-টথা বলেন। তাদের দীর্ঘ জীবনের এক ঘেয়েমি কাটানোর এটা একটা উপায়। যখন তাদের প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়, তখন আমরা ওদের নিয়ে নিই। মানবিক আবেগের প্রকৃতি বোঝার জন্যে নানান পরীক্ষানিরীক্ষা করি। গোলকধাঁধার পরীক্ষা হচ্ছে তার একটি।
কেউ কি সেই গোলকধাঁধা থেকে বেরুতে পেরেছে?
না পারে নি। আমি তোমাকে আগেই বলেছি, আমাদের গোলকধাঁধাটি যথেষ্ট জটিল।
ইরিনা রুদ্ধ। গলায় বলল, তুমি আমাকে বলেছিলে যদি আমি তোমাকে সাহায্য করি, তুমি আমাকে সাহায্য করবে। এই তোমার সাহায্যের নমুনা?
তুমি বুঝতে পারছি না। আমি কিন্তু তোমাকে সাহায্যই করছি।
আমি সত্যি বুঝতে পারছি না। কীভাবে সাহায্য করছ আমাকে?
গোলকধাঁধার কথা আগেই তোমাকে বলে দিলাম, এতে তুমি মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকার একটা সুযোগ পাচ্ছ, যা তোমার সঙ্গী পাচ্ছে না।
বাহ তোমার মহানুভবতায় মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছি। কী বিশাল তোমার হৃদয়!
তুমি মনে হচ্ছে আমার ওপর রাগ করলে?
ইরিনা উঠে দাঁড়িয়ে কঠিন গলায় বলল, নিয়ে চল আমাকে গোলকধাঁধায়।
তুমি ভয় পাচ্ছ না?
না, পাচ্ছি না।
তাহলে চল যাওয়া যাক।
ইরিনা হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে বলল, যদি আমরা বেরুতে না পারি, তখন কী হবে?
বেরুতে না পারলে যা হবার তাই হবে।
তার মানে?
তুমি একজন বুদ্ধিমতী মেয়ে, মানে বুঝতে না পারার কোনো কারণ দেখছি না।
তুমি বলেছিলে, অমর মানুষদের জন্য আমাদের আনা হয়েছে। আমাদের কি তাদের এখন আর প্রয়োজন নেই?
না। তাঁরা এখন এক জনকে নিয়ে ব্যস্ত। তাকে তুমি চেন। তার নাম অরচ লীওন।
তাঁর মন খুবই খারাপ
তাঁর মন খুবই খারাপ।
প্ৰায় এক ঘণ্টা তিনি তার ঘরের এ-মাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত হাঁটলেন। তার স্বভাব হচ্ছে কিছুক্ষণ পর পর সিডিসিকে ডেকে তার সঙ্গে কথা বলা। এই এক ঘণ্টায় তিনি এক বার সিডিসিকে ডাকেন নি। দুপুরের খাবার খান নি। সবচে বড় কথা, একবারও আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে মুগ্ধ চোখে দেখেন নি।
এইবার দাঁড়ালেন। নিজের চেহারা দেখে তেমন কোনো মুগ্ধতা তার চোখে ফুটল না। বরং ভুরু কুঞ্চিত করে তাকিয়ে রইলেন। যেন খুব বিরক্ত হচ্ছেন।
সিডিসি।
বলুন শুনছি।
আমাকে কি খুব উত্তেজিত মনে হচ্ছে?
হ্যাঁ, হচ্ছে।
তুমি কি জান, আমি কী নিয়ে উত্তেজিত?
জানি না, তবে অনুমান করতে পারি।
তোমার অনুমান কী?
আপনি অরচ লীওনের ব্যাপারে চিন্তিত।
মোটেই না। ওকে নিয়ে চিন্তিত হবার কী আছে?
কিছুই কি নেই?
না, কিছুই নেই। আমি আমার জন্যে নতুন একটা নাম ভাবছি। কোনোটাই মনে ধরছে না।
আপনি এই নিয়ে চিন্তিত?
এমন একটা নাম হতে হবে, যা ছোট, সুন্দর এবং কিছু পরিমাণে কাব্যিক। আবার বেশি কাব্যিক হলে চলবে না।
আমি কি নামের ব্যাপারে আপনাকে সাহায্য করব?
না।
তিনি আয়নার সমানে থেকে সরে দাড়ালেন। তাকে দেখে মনে হচ্ছে, তিনি চমৎকার একটি নাম খুঁজে পেয়েছেন। তাঁর মুখ হাসি হাসি। এবার হাত মুঠো করছেন, একবার খুলছেন। খুশি হলে তিনি এমন করেন।