বলুন।
খেলাটা তো কিছুতেই কায়দা করা যাচ্ছে না।
আমার কাছে ছেড়ে দিন, আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।
তাতে আমার লাভটা কি হল? আমি চাচ্ছি নিজে একটা খেলা বের করতে।
আপনি যা চাচ্ছেন তা তো হচ্ছে না। এই খেলা বহু প্ৰাচীন, আপনি শুধু তার ভেতর নতুনত্ব আনতে চেষ্টা করছেন।
সেটাই কম কি?
সেটা তেমন কিছু নয়। আপনার আগেও অনেকে চেষ্টা করেছে।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। আপনি চাইলে কারা কারা পরিবর্তন করেছেন, কী ধরনের পরিবর্তন, তা বলতে পারি।
আমি কিছুই জানতে চাই না।
তিনি উঠে দাঁড়ালেন। হাতের এ ঝটিকায় দাবার বোর্ড উল্টে দিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালেন। মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত বিশাল এক আয়না। সেই আয়নায় তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নিজেকে দেখছেন। তাঁর চোখে মুগ্ধ বিস্ময়।
সিডিসি।
বলুন।
আমাকে কেমন দেখাচ্ছে বল তো?
ভালো দেখাচ্ছে।
শুধু ভালো? এর বেশি কিছু নয়?
আপনি আমার কাছ থেকে কী ধরনের কথা শুনতে চাচ্ছেন বুঝতে পারছি না।
আমি যা শুনতে চাই তা-ই তুমি বলবে?
যদি সম্ভব হয় বলব। আপনি তো জানেন, আমি মিথ্যা বলতে পারি না। আমার বয়স কত?
আপনার বয়স পাঁচ শ এগার বছর তিন মাস দু দিন ছয় ঘণ্টা বত্রিশ মিনিট।
তিনি অত্যন্ত বিরক্ত হলেন। মুখ কুঁচকে বললেন, আমাকে দেখে কী মনে হয় তাই জানতে চাচ্ছি। আমাকে দেখে কি মনে হয় আমার বয়স পাঁচ শ?
না, তা মনে হয় না। ত্ৰিশের মতো মনে হয়, তবে—
আবার তবে কি?
আপনার মধ্যে বিশেষ এক ধরনের অস্থিরতা দেখছি, যা সাধারণ একজন ত্ৰিশ বছরের যুবকের থাকে না।
তুমি নিতান্তই মুখের মতো কথা বলছি।
হতে পারে।
তুমি আমার সঙ্গে এ রকম বুড়োদের মতো গলায় কথা বলছি কেন? তুমি কি আমাকে বুঝিয়ে দিতে চাও যে আমি একজন বুড়ো?
তা নয়।
তা নয়। মানে? অবশ্যই তোমার মনে এই জিনিস আছে।
আপনি আজ বিশেষ উত্তেজিত, তাই এরকম ভাবছেন।
এবং তুমি কথাও বেশি বল। অপ্রয়োজনে এখন থেকে একটি কথাও বলবে না।
ঠিক আছে, বলব না।
আমি নিজ থেকে কোনো প্রশ্ন করলে তবেই উত্তর দেবে। বুঝতে পারছ?
পারছি।
তিনি আয়নার সামনে থেকে সরে এলেন। তার ইচ্ছা করছে লাথি দিয়ে আয়নাটা ভেঙে ফেলতে। বহু কষ্টে তিনি নিজেকে সামলালেন। তাও পুরোপুরি সামলাতে পারছেন না। থারথার করে তার শরীর কাঁপছে।
সিডিসি।
বলুন।
কী করা যায় বল তো?
কোন প্রসঙ্গে বলছেন?
কী প্রসঙ্গে বলছি বুঝতে পারছি না? মুর্থ।
আপনি অতিরিক্ত রকম উত্তেজিত। আপনি চাইলে আপনাকে ঘুম পাড়িয়ে দিতে পারি।
এই মাত্ৰই তো জাগলাম।
আপনি অনেকক্ষণ আগেই জেগেছেন।
তাই নাকি?
প্রায় দশ ঘণ্টা ধরে দাবা নিয়ে চিন্তা করছেন। আমার মনে হয় এখন কিছু খাদ্য গ্রহণ করে ঘুমুতে যাওয়া উচিত।
ঘুম পাচ্ছে না।
আপনি শুয়ে থাকুন, আমি নিও ফ্রিকোয়েন্সি বদলে দিচ্ছি। সেই সঙ্গে মধুর কোনো সংগীতের ব্যবস্থাও করছি।
মধুর সংগীত বলেও কিছু নেই।
তিনি লক্ষ করলেন তার উত্তেজনা কমে আসছে। হয়তো ইতোমধ্যেই সিডিসি নিও ফ্রিকোয়েন্সি কমাতে শুরু করেছে। দূরাগত বিষাদময় সংগীতও তিনি শুনতে পাচ্ছেন। এই সংগীত বিষাদময় হলেও কোনো এক অদ্ভুত কারণে মন শান্ত করে। গানের কথাগুলো অস্পষ্টভাবে কানে আসছে।
হে প্ৰিয়তম!
তুমি কি দূর থেকেই আমাকে দেখবে?
আজ বাইরে কী অপূর্ব জোছনা।
সেই আলোয় তুমি এবং আমি কখনো কি
নিজেদের দেখব না?
তিনি ক্লান্ত গলায় ডাকলেন, সিডিসি!
শুনেছি।
জীবন খুব একঘেয়ে হয়ে যাচ্ছে সিডিসি।
দীর্ঘ জীবন কিছুটা ক্লান্তিকর হয়ে পড়ে। মধুর সংগীত, মহান শিল্পকর্মও একসময় অর্থহীন মনে হয়।
তিনি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। সিডিসি বলল, আপনার জীবনে কিছুটা উত্তেজনা আনার ব্যবস্থা করেছি।
কী রকম?
প্রথম শহরের দুজন নাগরিককে নিয়ে আসা হয়েছে। ওদের সঙ্গে কথা বললে কিছুটা বৈচিত্ৰ্য আপনি পেতে পারেন।
আমার বৈচিত্র্যের প্রয়োজন নেই।
প্রয়োজন আছে। সম্পূর্ণ দুধরনের দুজন মানুষকে আনা হয়েছে। ওদের কাণ্ডকারখানা দেখতে আপনার ভালো লাগবে।
তোমার কথা শুনেই আমার অসহ্য বোধ হচ্ছে। ওদের মুহূর্তে ফেরত পাঠাও।
নিষিদ্ধ নগরী থেকে কাউকে ফেরত পাঠাবার নিয়ম নেই।
তাহলে মেরে ফেলি।
মেরে ফেলব?
হ্যাঁ, মেরে ফেলবে। এবং মৃত্যুর সময় ওদের ফিল্ম করে রাখবে। পরে এক সময় দেখব। আমার মনে হয় দেখতে ভালো লাগবে।
ঠিক আছে। মৃত্যুর আগে ওদের একবার দেখতে চান না?
না, মেরে ফেল। ওদের মেরে ফেল।
ঠিক আছে।
কষ্ট দিয়ে মারবে। খুব কষ্ট দিয়ে মারবে।
তাই করব।
আমি এখক ঘুমুব। ঘুম পাচ্ছে।
তিনি মেঝেতেই এলিয়ে পড়লেন। অপূর্ব সংগীত হতে থাকল,
হে প্ৰিয়তম,
আজ এই বসন্তের দিনে আকাশ এমন মেঘলা কেন?
আকাশ কি আমার মনের কষ্ট বুঝে ফেলল?
তা কেমন করে হয়?
আমার যে কষ্ট তা তো আমি নিজেই জানি না।
আকাশ কি করে জানবে?
তিনি গাঢ় ঘুমে তলিয়ে পড়লেন। ঘরের আলো কমে এল। সংগীত অস্পষ্ট হয়ে আসছে। তিনি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে মধুর স্বপ্ন দেখছেন। সেই স্বপ্নের কোনো অর্থ নেই, তবু মনে হচ্ছে অর্থ আছে।
তাঁর ঘুম ভাঙল।
ঘর অন্ধকার। তার চোখ মেলার সঙ্গে সঙ্গেই ঘর আলো হতে শুরু করল। তিনি বুঝতে পারলেন যতক্ষণ তার ঘুমানোর কথা, তিনি তার চেয়েও বেশি সময় ঘুমিয়েছেন। হয়তো অনেক বেশি সময়। কারণ তাঁর পাশে একটি চিকিৎসক রোবট। রোবটটি আন্তরিক স্বরে বলল, কেমন আছেন?
তিনি বিরক্তিতে ভুরু কুচকে ফেললেন। চিকিৎসক রোবট জিজ্ঞেস করছে, কেমন আছেন। এই প্রশ্নের জবাব তারই দেয়া উচিত। তা দিচ্ছে না, জিজ্ঞেস করছে- কেমন আছেন। ব্যাটা ফাজিল।