তই নাকি?
হ্যাঁ তাই। বরং তোমার মিল আছে Q23 মডেলের রোবটদের সঙ্গে।
ওরা কি করে?
Q23 হচ্ছে পরীক্ষামূলক জ্ঞান-সংগ্ৰহী রোবট। তাদের একমাত্র কাজ হচ্ছে পৃথিবীর যাবতীয় জ্ঞান সংগ্ৰহ করা। প্রাণিবিদ্যা, ভূ-তত্ত্ব, সমুদ্রবিদ্যা, অঙ্কশাস্ত্ৰ, জ্যোতির্বিদ্যা, রসায়ন, পদার্থবিদ্যা- সব।
আমি তাহলে একজন Q23 রোবট?
খানিকটা সে রকমই।
আমি একজন Q23 রোবটের সঙ্গে কথা বলতে চাই। সেই ব্যবস্থা কি করা যাবে?
নিশ্চই করা যাবে।
তাহলে ব্যবস্থা কর। আমি যা শেখার তার কাছেই শিখতে চাই। তোমার সঙ্গে কথাবার্তা বলে মনে হচ্ছে— তোমার বুদ্ধি শুদ্ধি তেমন নেই। তুমি একজন গবেট ধরনের রোবট।
রোবটটির মারকারি চোখ একটু বুঝি স্তিমিত হল। গলার স্বর ক্লান্ত শোনাল। সে থেমে থেমে বলল, আমি কি বোকার মতো কোনো আচরণ করেছি?
না, এখনো কর নি, তবে মনে হচ্ছে করবে। দেরি করছ, কেন, যাও একটি Q23 নিয়ে এস।
এক্ষুণি আনতে হবে?
হ্যাঁ এক্ষুণি। আমি তো আর অমর নই। আমার সময় সীমাবদ্ধ। এই সীমাবদ্ধ সময়ের মধ্যেই যা পারি জানতে চাই। দাঁড়িয়ে বকবক করার চেয়ে Q23 নিয়ে এস।
রোবটটির আকৃতি ছোট। লম্বায় তিন ফুটের মতো। গড়িয়ে গড়িয়ে চলে। মানুষের কাঠামোর সঙ্গে তার কাঠামোর কোনো মিল নেই। দেখায় ছোটখাটাে একটা লম্বাটে বাক্সের মতো। অন্যান্য রোবটদের যেমন আশেপাশের দৃশ্য দেখার জন্যে মারকারি চোখ কিংবা লেজার চোখ থাকে, এর তা-ও নেই। মীর বলল, তুমি কেমন আছ?
Q23 উত্তর দিল না। মনে হচ্ছে সে এ জাতীয় সামাজিক প্রশ্ন বিশেষ পছন্দ করছে না।
তুমি কি আমাকে একজন ছাত্র হিসেবে নেবে?
আমি নিজেই ছাত্র, এখনো শিখছি।
খুব ভালো কথা, আমাকেও কি তার ফাঁকে ফাঁকে কিছু শেখাবে?
নিশ্চয়ই। তুমি যদি চাও শেখাব। কেন শেখাব না! তুমি কী জানতে চাও?
আমি সব জানতে চাই। একেবারে গোড়া থেকে শুরু করতে চাই। আ আ থেকে।
দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার।
তা তো বটেই। আমি তো আর অমর না। মরণশীল মানুষ। সময় তেমন নেই, তবু এর মধ্যেই যা পারা যায়। ভালো কথা, অমর ব্যাপারটা আমাকে বুঝিয়ে দাও তো।
তোমার প্রশ্ন বুঝতে পারছি না।
মানুষ আমর হয় কীভাবে? নিষিদ্ধ নগরীতে কিছু অমর মানুষ থাকেন বলে শুনেছি, তারা অমর হলেন কীভাবে? অবশ্যি তোমার যদি বলতে বাধা থাকে, তাহলে বলার দরকার নেই।
কোনোই বাধা নেই। অনেক দিন থেকেই মানুষ অমর হবার চেষ্টা করছিল। শারীরিকভাবে অমর— মৃত্যুকে জয় করা। শুরুতে এটাকে একটি অবিশ্বাস্য ব্যাপার মনে করা হত। জীবনের একটি লক্ষণ হিসেবে মৃত্যুকে ধরা হত। বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে জরাকে জয় করার গবেষণা জোরেসোরে শুরু হল। বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে বিজ্ঞানীরা জরার কারণ বের করেলেন। তারা মানুষের শরীরে একটি বিশেষ বয়সে এক ধরনের হরমোন আবিষ্কার করলেন। এটা একটা ভয়াবহ হরমোন। যেই মুহুর্তে এটি রক্তে এসে মেশে, সেই মুহুর্ত থেকে মানুষ এগিয়ে যেতে থাকে মৃত্যুর দিকে। যতগুলো জীবকোষ শরীরে স্বাভাবিক নিয়মে মৃত্যুবরণ করে, ঠিক ততগুলো জীবকোষ আর তৈরি হয় না। শরীর অশক্ত হয়। শরীরের যন্ত্রগুলো দুর্বল হতে থাকে। কালক্রমে মৃত্যু। বিজ্ঞানীরা সেই ঘাতক হরমোনের নাম দিলেন মৃত্যু হরমোন।
মৃত্যু হরমোন আবিষ্কারের বাকি কাজ খুব সহজ হয়ে গেল। বিজ্ঞানীরা মৃত্যু হরমোনকে অকেজো করার ব্যবস্থা করলেন। আজ থেকে প্রায় পাঁচশ বছর আগে পৃথিবীতে অসাধারণ একটা ঘটনা ঘটল। চল্লিশ জন অল্পবয়স্ক বিজ্ঞানী মৃত্যু হরমোন অকেজো করে এমন একটি রাসায়নিক বস্তু নিজেদের শরীরে ঢুকিয়ে দিলেন!। তাঁরাই পৃথিবীতে প্রথম এবং শেষ অমর মানুষ। নিষিদ্ধ নগরীতে তারাই থাকেন।
মীর বলল, শুধু ঐ চাল্লিশ জন অমর হল কেন? পৃথিবীর সবাই অমর হয়ে গেল না কেন? অমর হবার ওষুধ তো তারাও খেতে পারতো।
না, তা পারত না। তাতে নানান রকম অসুবিধা হত, নানান সমস্যা দেখা দিত।
কি সমস্যা?
আমি তা জানি না। সামাজবিজ্ঞানীরা জানবেন। আমি ভৌত জ্ঞান সং করি। সমাজবিদ্যা সম্পর্কে কিছু জানি না।
এমন কোনো রোবট কি আছে, যে সমাজবিদ্যা জানে?
না নেই। নিষিদ্ধ নগরীর বিজ্ঞানীরা সমাজবিদ্যায় উৎসাহী নন। তুমি এখন কী জানতে চাও?
বিজ্ঞান ভালোমতো শিখতে হলে প্ৰথমে কোন জিনিসটি জানতে হবে? প্ৰথম জানতে হবে অঙ্কশাস্ত্ৰ। অঙ্ক হচ্ছে বিজ্ঞানকে বোঝার জন্য একটি বিদ্যা।
তাহলে অঙ্কই শুরু করা যাক। তুমি একেবারে গোড়া থেকে শুরু করবে।
বেশ, মৌলিক সংখ্যা দিয়ে শুরু করা যাক। কিছু কিছু সংখ্যা আছে যাদের শুধুমাত্র সেই সংখ্যা ছাড়া অন্য কোনো সংখ্যা দিয়ে ভাগ দেয়া যায় না। এদের বলে মৌলিক সংখ্যা; যেমন- ১, ৩, ৫, ৭, ১১, ১৩, ১৭, ১৯, ২৩…
মীর মুগ্ধ হয়ে শুনছে।
আনন্দ ও উত্তেজনায় তার চোখ জ্বলজ্বল করছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে এই মুহুর্তে তার চেয়ে সুখী মানুষ পৃথিবীতে আর কেউ নেই।
দাবা সেটের সামনে
তিনি বসে আছেন একটি দাবা সেটের সামনে।
দাবা সেটটি অন্যগুলোর মতো নয়। এখানে স্কয়ারের সংখ্যা একাশিটি। তিনটি নতুন পিস যুক্ত করা হয়েছে। এই পিসগুলোর কর্মপদ্ধতি কী হলে খেলােটাকে যথেষ্ট জটিল করা যায়, তা-ই তিনি ভাবছিলেন। মাঝে মাঝে কথা বলছেন সিডিসির সঙ্গে। সিডিসি হচ্ছে নিষিদ্ধ নগরীর মূল কম্পিউটার। সিডিসির শব্দ তৈরির অংশটি অসাধারণ। সে যখন যেমন স্বর প্রয়োজন, তখন সে রকম স্বর বের করে। তিনি যখন ঘুমুতে যান, তখন সিডিসি কিশোরী কণ্ঠে তাঁর সঙ্গে কথা বলে। এখন কথা বলছে বৃদ্ধের গলায়। ভারি, ভাঙা ভাঙা— খানিকটা যেন শ্লেষ্মােজড়িত। তিনি দাবার বোর্ড থেকে চোখ না। সরিয়েই ডাকলেন, সিডিসি।