ইরিনা কফির কাপ নামিয়ে রেখে আগ্রহের সঙ্গে খাবার খেতে শুরু করল। সবই তরল এবং জেলি জাতীয় খাবার। ঝাঁঝালো ভাব আছে, তবে খেতে চমৎকার।
রোবটটি বলল, খেতে ভালো লাগছে?
হ্যাঁ লাগছে।
তোমার শরীরে প্রয়োজন এবং রুচি– এই দুটি জিনিসের ওপর লক্ষ রেখে খাবার তৈরি হয়েছে। তোমার খারাপ লাগবে না।
ইরিনা বলল, নিষিদ্ধ নগর সম্পর্কে কৌতূহল প্রকাশ করা নিষিদ্ধ কিন্তু আমি যা প্রশ্ন করছি, তুমি তার জবাব দিচ্ছি।
জবাব দিচ্ছি, কারণ তুমি নিষিদ্ধ নগরীতেই আছ। তোমার জন্যে নিষিদ্ধ নয়। কারণ তুমি এসব প্রশ্নের জবাব কখনো প্ৰথম শহরে পৌঁছে দিতে পারবে না। বাকি জীবনটা তোমার এ জায়গাতেই কাটবে।
তাই বুঝি?
হ্যাঁ তাই।
নিষিদ্ধ নগরীর মানুষরা কত দিন ধরে বেঁচে আছেন?
পাঁচশ বছরের মতো। তাদের জন্ম হয়েছে ধ্বংসযজ্ঞের আগে।
তারা অনন্তাকাল বেঁচে থাকবেন?
হ্যাঁ থাকবেন।
তারা আমাকে কখন ডেকে পাঠাবেন?
তা তো বলতে পারছি না। হয়তো আগামীকালই ডেকে পাঠাবেন। হয়তো দশ বছর পর ডাকবেন। সময় তাদের কাছে কোনো সমস্যা নয় বুঝতেই পারছ।
তারা যদি দশ বছর পর ডাকেন, এই দশ বছর আমি কী করব?
অপেক্ষা করবে।
কোথায় অপেক্ষা করব?
এইখানে। এই ঘরে।
তুমি কী পাগলের মতো কথা বলছ! আমি এই জায়গায় দশ বছর অপেক্ষা করব?
আরো বেশিও হতে পারে। সময় তোমার কাছে একটা সমস্যা, তাদের কাছে কোন সমস্যা নয়। তবে ভয় পেও না, তোমার সময় কাটানোর ব্যবস্থা আমি করব। খেলাধুলা, গান-বাজনা, বইপত্র- সব ব্যবস্থা থাকবে।
ইরিনার শিরদাঁড়া দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। কি বলছে ও! এ তো অসম্ভব কথা। রোবটটি তার যান্ত্রিক মুখে হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে বলল, তোমার যখন নেহায়েত অসহ্য বোধ হবে, তখন আমরা তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখব। আরামের ঘুমা। ছয়, সাত বা আট বছর কাটিয়ে দেবে শান্তির ঘুমে।
ইরিনা বলল, এ রকম কি হয়েছে কখনো? কাউকে আনা হয়েছে প্রথম শহর থেকে, নিষিদ্ধ নগরীর কেউ তার সঙ্গে দেখা করে নি? সে জীবন কাটিয়ে দিয়েছে আমার মতো এরকম ঘরে?
তা তো হয়েছেই। ঠিক এই মুহুর্তেই তোমার মতো আরো চারজন অপেক্ষা করছে। এই চার জনের দুজন অপেক্ষা করছে কুড়ি বছর ধরে। এখনো দেখা হয় নি। ওদের ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। আমার মনে হয়। ঘুমুতে ঘুমুতেই ওরা এক সময় মারা যাবে।
আর বাকি দুজন?
ওরা এসেছে ছয় বছর আগে। এখন পর্যন্ত তারা ভালোই আছে। ঘুমেই আছে।
আমি কি তাদের সঙ্গে কথা বলতে পারি?
না।
আমি কি মীরের সঙ্গে কথা বলতে পারি?
না।
মীর কেমন আছে তা কি জানতে পারি?
না।
ইরিনা চিৎকার করে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। ছুটে গিয়ে আছড়ে পড়ল দেয়ালে। যে দেয়াল তার কাছে বায়বীয় মনে হচ্ছিল, দেখা গেল তা মোটেই বায়বীয় নয়। ইস্পাতের মতো কঠিন। বরফের মতো শীতল।
মীর মহাসুখী
মীর মহাসুখী।
বছরের পর বছর তাকে এই ঘরে কাটাতে হতে পারে এই সম্ভাবনায় সে। রীতিমতো উল্লাসিত। সে হাসিমুখে রোবটকে বলল, সময় কাটান নিশ্চয়ই কোনো সমস্যা হবে না?
না, তা হবে না।
পড়াশোনার জন্য প্রচুর বইপত্র নিশ্চয়ই আছে?
তা আছে।
পড়াশোনার বিষয়ের ওপর কি কোনো বিধিনিষেধ আছে?
না, নেই।
বাতি কী করে জ্বলে, বা হিটারে পানি কী করে গরম হয় যদি জানতে চাই জানতে পারব?
নিশ্চয়ই পারবে। তুমি কি এখনি জানতে চাও?
হ্যাঁ চাই।
তাহলে তোমাকে প্ৰথমে জানতে হবে ইলেকট্রিসিটি সম্পর্কে। ইলেকট্রিসিটি হচ্ছে ইলেকট্রন নামের ঋণাত্মক কণার প্রবাহ।
ঋণাত্মক কণা ব্যাপারটা কি?
তোমাকে তাহলে আরো গোড়ায় যেতে হবে। জানতে হবে বস্তু কি? অণু এবং পরমাণুর মূল বিষয়টি কি?
বল, আমি শুনছি?
তুমি কি সত্যি সত্যি পদ্ধতিগত শিক্ষা গ্ৰহণ করতে চাও?
হ্যাঁ চাই। পদ্ধতি-ফদ্ধতি জানি না, আমি সবকিছু শিখতে চাই। সময় নষ্ট করতে চাই না।
তোমাকে আগ্রহ নিয়েই আমি শেখাব। তুমি কি নিষিদ্ধ নগরীর অমর মানুষদের সম্পর্কে কিছু জানতে চাও না?
না।
এরা কী করে অমর হলেন, মৃত্যুকে জয় করলেন— সে সম্পর্কে তোমার কৌতূহল হয় না?
না।
তোমার বান্ধবীর প্রসঙ্গেও কি তোমার কৌতূহল হচ্ছে না? ইরিনা যার নাম?
সে আমার বান্ধবী, তোমাকে বলল কে? বান্ধবী-ফান্ধবী নয়।
সে। কিন্তু খুব মন খারাপ করেছে। দীর্ঘদিন এই ছোট্ট ঘরে তাকে কাটাতে হতে পারে শুনে সে প্ৰায় মাথা খারাপের মতো আচরণ করছে। শেষ পর্যন্ত তাকে ঘুম পাড়িয়ে দিতে হয়েছে।
ভালো করেছ। মেয়েটা নার্ভাস ধরনের এবং বোকা। সব জিনিস জানার এমন চমৎকার একটা সুযোগ পেয়েও কেউ এমন করে?
রোবটটি দীর্ঘনিঃশ্বাসের মতো শব্দ করে বলল, মানুষ বড়ই বিচিত্র প্রাণী। এক জনের সঙ্গে অন্য জনের কোনোই মিল নেই। অথচ এক মডেলের প্রতিটি রোবট এক রকম। তারা একই পদ্ধতিতে ভাবে, এই পদ্ধতিকে বিচার-বিশ্লেষণ করে।
মীর রোবটের কথায় কোনো কান দিচ্ছে না। সে হাসি-হাসি মুখে পা নাচাচ্ছে। শিসের মতো শব্দ করছে। এসব তার আনন্দের বহিঃপ্ৰকাশ। সে হঠাৎ পা নোচান বন্ধ করে গম্ভীর মুখে বলল, আচ্ছা শোনো, আমাকে আমর করে ফেলার কোনো রকম সম্ভাবনা কি আছে?
কেন বল তো?
তাহলে নিশ্চিন্ত মনে থাকা যেত। যা কিছু শেখার সব শিখে ফেলতাম। অমর না হলে তো সেটা সম্ভব হবে না। কতদিনই বা আমি আর বাঁচব বল?
তুমি বেশ অদ্ভুত মানুষ!
তাই নাকি?
হ্যাঁ।
মানুষের চরিত্র, আচার-আচরণ সম্পর্কে যে তথ্য আমাদের মেমোরি সেলে আছে তার কোনোটিতেই তোমাকে ফেলা যাচ্ছে না।