আমরা টানেল-কর্মীরা টানেলে ফিরে যেতে চাই। আমরা যখন টানেলে নামি তখন শান্তি-শান্তি লাগে, মনে হয় মায়ের পেটে ঢুকে যাচ্ছি। অতি নিরাপদ আশ্রয়ে যাচ্ছি। আর আমাদের কোন সমস্যা নেই।
টানেলে কাজ করার অনেক মজাও আছে। আমরা সূর্য-ভাতা পাই। যে। কদিন সূর্য দেখতে পাচ্ছি না সে কদিনের সূর্য-ভাতা। প্রতি চব্বিশ ঘণ্টায় ২ ইউনিট। অনেক বড় ব্যাপার। পাঁচ বছর কাজ করতে পারলে আমরা থাকার কোয়ার্টারের জন্যে আবেদন করতে পারি। কোয়ার্টার পাবার সম্ভাবনা প্রায় আশি ভাগ। তবে সমস্যা হচ্ছে টানেল-কর্মীরা বেশিদিন তাদের কোয়ার্টারে থাকতে পারে না। সূর্যের আলো তাদের অসহ্য বোধ হয়। খোলা বাতাসে তারা নিশ্বাস পর্যন্ত নিতে পারে না। তাদের জীবন কাটে টানেলে টানেলে। অনেকের কাছে সেই জীবনটা হয়ত আনন্দময় নয় তবে আমাদের জন্যে ঠিকই আছে। টানেলেই আমাদের ঘর। আমাদের জীবন।
মহাকাশযানে আমি বর্তমানে যে ঘরে বাস করছি তার সঙ্গে টানেলের কিছু মিল আছে। আমি ঘর থেকে বের হতে পারি না। টানেল থেকেও বের হওয়া সম্ভব না। টানেলে কথা বলার কেউ থাকে না আশেপাশে কিছু কর্মী রোবট থাকে তারা কথা বলতে পারে না। শুধু কাজ করতে পারে। এখানেও তাই, কথা বলার জন্যে রোবট ছাড়া আর কেউ নেই। তবে এখানে খাবারদাবারের ব্যবস্থা ভাল, অবশ্যই ভাল। এই যে আমি এখানে শুয়ে আছি, আমার ঘুম আসছে না। এখন আমি যদি খাবারঘরে যাই সঙ্গে সঙ্গে মেয়ে-রোবটটা চলে আসবে। আমি তাকে যদি বলি, কফি খাওয়াতে পার? সে কফি বানিয়ে আনবে। সেই কফি সিনথেটিক কফি, কিন্তু কারোর বোঝার সাধ্য নেই। কফির যেমন গন্ধ তেমন স্বাদ। খাবার বানানোর এরকম একটা যন্ত্ৰ কিনতে কত ইউনিট লাগে? আমার সারা জীবনের সঞ্চয় দিয়ে এরকম একটা যন্ত্ৰ কিনে ফেলতে পারলে কাজের কাজ হত। ফ্লেটিশ মাছের ডিম-ফিম খেয়ে জীবন পার করে দিতে পারতাম।
আমার মাথার কাছে সবুজ একটা বাতি কিছুক্ষণ ধরেই জ্বলছে-নিভছে। বাতিটা এতক্ষণ নেভা ছিল। হঠাৎ বাতিটা পাগল হয়ে গেল কেন? এই সব বাতির মানে কী আমি জানি না। শুধু জানি খিদে পেলে কী করতে হয়।
টানেলে আমি সুখে ছিলাম। না না সুখে ছিলাম বলা ঠিক হবে না মহাসুখে ছিলাম। সারাদিন কাজ করি, সন্ধেবেলা ঘুমুতে আসি। দিনে প্রচুর পরিশ্রম হয় বলে রাতে ঘুম ভাল হয়। শোয়ামাত্র চোখে ঘুম জড়িয়ে আসে। তারমধ্যেও মনে মনে হিসেব করি ঠিক কত ইউনিট জমল। পাঁচ হাজার ইউনিট জমলে বিয়ের লাইসেন্স করতে পারি। টানেল কর্পোরেশনকে সেই লাইসেন্স দেখালে কোন একজন মহিলা টানেল-কর্মীকে তারা খুঁজে বের করবে। আমার নামে বরাদ্দ দিয়ে দেবে। ডিএনএ ম্যাচিং করে মেয়ে খোঁজা হবে, কাজেই ধরে নেয়া যায় যে আমাদের জীবনটা সুখেরই হবে। দুজন দুজনকে পছন্দ করব। সন্ধ্যার পর যখন কাজ থাকবে না তখন দুজন নানান গল্প করব। তেমন ইউনিট যদি জমাতে পারি তাহলে কয়েকদিনের জন্যে কোন একটা রিসোর্টে বেড়াতেও যেতে পারি। কোথায় যাব সেটা ঐ মেয়েটাকেই ঠিক করতে দেব। তার যদি সমুদ্রের কাছে যেতে ইচ্ছা করে তাহলে যাব সমুদ্রের কাছে। যদিও সমুদ্র আমার ভাল লাগে না। সারাক্ষণ একঘেয়ে শব্দ। সমুদ্রের কাছে আলোও বেশি, খুব চোখে লাগে। তারপরেও মেয়েটির আনন্দকে আমি গুরুত্ব দেব। আমি যদি তার আনন্দকে গুরুত্ব না দেই সে আমার আনন্দকে গুরুত্ব দেবে না।
আমি ঠিক করে রেখেছি বিয়ের পরে আমি একটা নিষিদ্ধ কাজও করব। মেয়েটার একটা নাম দেব। টানেল-কর্মীদের কোন নাম থাকে না। তাদের থাকে নাম্বার। নাম্বারটা খুব প্রয়োজনীয় ব্যাপার। নাম্বার থেকে সঙ্গে সঙ্গে বলা যায় টানেল-কর্মী কোথায় কাজ করছে, কী ধরনের কাজ করছে, কত দিন হল কাজ করছে, সে থাকে কোথায়। নাম্বারই টানেল কর্মীর নাম ঠিকানা, পরিচয়। যেমন আমার নাম হল T5023G00/LOR420/S000129, এটা হল আমার পুরো নাম। ঘোট নাম হল T5LASO.
নাম ব্যবহার আমাদের জন্যে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তারপরেও কাউকে না জানিয়ে মেয়েটার আমি যদি সুন্দর একটা নাম দেই তাতে ক্ষতি তো কিছু নেই। যখন আমাদের কোন কাজকর্ম থাকবে না। দুজন একাকী বসে থাকব তখন এই নামে তাকে ডাকব।
আমি প্রতিরাতেই একটা না একটা নাম নিয়ে ভাবি। এখন আমাদের সবচে পছন্দের নাম হল ইমা। ইমা নামের মেয়েটার কথা ভাবতে-ভাবতেই আমি প্রতিরাতে ঘুমুতে যাই। ঘুমের মধ্যে ইমাকে মাঝে-মধ্যে আমি স্বপ্নে দেখি লাজুক-টাইপ রোগামতো একটা মেয়ে, লম্বা চুল, বড়-বড় চোখ। চোখের পল্লব এত দীর্ঘ এবং ঘন যে মেয়েটির দিকে তাকালে মনে হবে গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে আমি মেয়েটির চোখ দেখছি। মেয়েটা কোন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলে উত্তর দেয় না, শুধু হাসে।
আমার মতো সাধারণ এবং নিরীহ একটা মানুষ কী করে মহাকাশযান সংক্রান্ত জটিলতায় জড়িয়ে পড়ে তা আমার মাথায় আসে না। মাঝে মাঝে চেয়ারে বসে-বসে ভাবি, পুরো ব্যাপারটা স্বপ্ন বলে মনে হয়, মনে হয় আসলেই হয়ত স্বপ্ন। একসময় স্বপ্ন ভেঙে যাবে এবং মোটামুটি অবাক হয়েই দেখব আমি ঠিক আগের জায়গাতেই আছি, টানেল-হোস্টেলের ৩২৩ নাম্বার বিছানায়। আমি বিছানা থেকে নামব, পানি খাব, বাথরুমে যাব তারপর আবার আগের জায়গায় এসে ঘুমুতে শুরু করব। ঘুম না এলে মাথার কাছের রিডিং-লাইট জ্বালিয়ে বইটই পড়ার চেষ্টা করব। ও হ্যাঁ আমার বই পড়ার বদঅভ্যাস আছে। রাজ্যের বই পড়ি।