ফ্লেটিশ মাছের ডিম।
মাছের ডিম আমি জীবনে খাই নি। ডিমের আঁশটে গন্ধে আমার বমি আসে। ফ্লেটিশ মাছের তো নামও শুনিনি।
ফ্লেটিশ একধরনের সামুদ্রিক মাছ। পানির অনেক নিচে থাকে। তাদের ডিম হয় সবুজ রঙের।
শুনেই তো আমার গা গুলাচ্ছে।
আপনি খেয়ে দেখুন আপনার কাছে অসম্ভব সুস্বাদু মনে হবে। আপনার ডিএনএ প্রফাইল তাই বলে।
রোবট মেয়ের কথা শুনে খেলাম ফ্লেটিশ মাছের ডিম। আসলেই এত সুস্বাদু খাবার আমি আমার এই জন্মে খাই নি।
মহাকাশযানের ফুড ডিপার্টমেন্ট যে অসাধারণ এটা আমি বলতে পারি। খাওয়াদাওয়া নিয়ে আমার কোন অভিযোগ নেই। অভিযোগের প্রশ্ন তো আসেই না। আমি আসলে খুশি। খুবই খুশি। খিদে লাগলেই আমার মন ভাল হয়ে যায়। খেতে খেতে রোবট-মেয়ের সঙ্গে গল্প করি। রোবটটাকে মেয়ে বলার কোন কারণ নেই। ওর গলার স্বরটাই শুধু মেয়ের। সমস্যা হচ্ছে খাওয়াদাওয়ার বাইরে এই রোবট-মেয়ে কিছু জানে না। আমাদের সমস্ত আলাপ খাওয়াদাওয়া নিয়ে।
তারপর বল আজ কী খাওয়াবে?
আপনি যা খেতে চাইবেন তাই খাওয়াবো।
আচ্ছা শোন যা খাচ্ছি সবই কি আসল খাবার না নকল খাবার?
অবশ্যই আসল খাবার। তবে প্রকৃতি থেকে পাওয়া নয়, ল্যাবোরেটরিতে তৈরি।
অর্ডার দিলেই মেশিন থেকে খাবার বের হয়ে আসে?
অনেকটা তাই। পৃথিবীর যাবতীয় খাবারের মাত্র ছটা গুণ থাকে। টক, ঝাল, মিষ্টি, নোনতা, তিতা এবং গন্ধ। এই ছটা জিনিসের হেরফের করে আপনার জন্যে খাবার তৈরি করে দেয়া হয়।
আমি যে ফ্লেটিশ মাছের ডিম খাই সেই ডিম আসলে ফ্লেটিশ মাছের পেট থেকে আসে না?
অবশ্যই না।
আচ্ছা ধর আমাদের খাবার-তৈরি যন্ত্রটা নষ্ট হয়ে গেল। তখন কী হবে। আমরা না খেয়ে বসে থাকব?
আপনি খুবই অস্বাভাবিক সম্ভাবনার কথা বলছেন। খাদ্য তৈরির প্রক্রিয়া মূল কম্পিউটার নিয়ন্ত্রণ করে। কম্পিউটার সিডিসি।
কম্পিউটার সিডিসি নিয়ন্ত্রণ করলে কোন ভুল হতে পারে না?
অবশ্যই না।
কেন কম্পিউটার কি ভুল করে না?
কম্পিউটার সিডিসি ভুল করে না। সে সব জানে। সব কিছু বোঝে।
তোমার ধারণা সে ঈশ্বরের কাছাকাছি? ঈশ্বর কে?
বাদ দাও। ঈশ্বর কে তুমি বুঝবে না। আমি নিজেও বুঝি না। তোমাদের এই কম্পিউটার সিডিসি কি বলতে পারবে কেন আমাকে এই মহাকাশযানে আনা হল। আমাকে এরা কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?
অবশ্যই বলতে পারবে।
তাকে জিজ্ঞেস করলে আমি জানতে পারব?
সে যদি ইচ্ছা করে আপনার প্রশ্নের উত্তর দেবে তাহলে আপনি জানতে পারবেন। যদি উত্তর না দেয় তাহলে জানতে পারবেন না।
আমি বিজ্ঞের মতো বললাম, বিজ্ঞান কাউন্সিলের নীতিমালায় তো আছে। মানুষের যে কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে কম্পিউটার বাধ্য। মানুষের কাছ থেকে সে কিছু লুকাতে পারবে না। আমি আইনকানুন ভাল জানি না। তবে এই আইনটি জানি। এই আইনের নাম বিশেষ অধিকার আইন।
কম্পিউটার সিডিসি সব প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য না। বিজ্ঞান কাউন্সিলের নীতিমালা উড়ন্ত মহাকাশযানগুলির জন্যে প্রযোজ্য নয়।
আচ্ছা শোন এই যে আমি তোমার সঙ্গে কথাবার্তা বলছি কম্পিউটার সিডিসি কি তা শুনছে?
অবশ্যই শুনছে। মহাকাশযানে যেখানে যা ঘটছে তার প্রতিটি সংবাদ সিডিসির মেমোরি সেলে চলে যাচ্ছে।
তাহলে আমি যদি সিডিসিকে এখন গালাগালি করি তা সে শুনবে?
অবশ্যই শুনবে।
আমার ধারণা তোমাদের সিডিসি মোটামুটি গাধা-টাইপ একটা কম্পিউটার। সে নিজেকে খুব বুদ্ধিমান। আমি বর্তমানে যে মানসিক কষ্টের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি তা সে বুঝতে পারত, এবং কষ্ট কমাবার চেষ্টা করত। আমি যদি জানতে পারতাম কেন আমাকে মহাকাশযানে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এবং কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তাহলেই হত। আমি কিছুই জানি না।
স্যার আপনাকে কি একটা মিক্সড ড্রিংক দেব, ড্রিংকটা এমন যে আপনার মানসিক উত্তেজনা দূর করতে সাহায্য করবে।
আচ্ছা দাও।
একটা ড্রিংকের জায়গায় আমি পর-পর চারটা ড্রিংক খেয়ে ফেললাম। ড্রিংকটা ঝাঁঝালো টক-টক স্বাদ। টকের ভেতর সামান্য মিষ্টি ভাবও আছে। খাবার পর-পর মাথা এলোমেলো লাগছে। কে জানে নেশা হয়েছে কি না। কারণ রোবট-মেয়েটাকেও দেখতে এখন খারাপ লাগছে না। তার নীল আলোর চোখেও মনে হয় একটু মায়া-মায়া ভাব চলে এসেছে। এমনকি মহাকাশযানটাকেও আমার খারাপ লাগছে না। নিজেকে হালকা ফুরফুরে লাগছে। মনে হচ্ছে ভালই তো নিরুদ্দেশের দিকে যাত্রা। ভবিষ্যতে কিছু একটা হবে। সেটা আনন্দময় হতে পারে আবার নিরানন্দময়ও হতে পারে। আনন্দময় হলে তো ভালই। নিরানন্দময় হলেও-বা ক্ষতি কি? আনন্দ ও নিরানন্দ নিয়েই তো জগৎ।
আমার হঠাৎ করেই গান গাইতে ইচ্ছা করছে। সমস্যা একটাই আমার, গানের গলা নেই। তাতে কি? সব মানুষকে তো আর গানের গলা দিয়ে পৃথিবীতে পাঠানো হয় না। আমি আমার হেড়েগলাতেই গান গাইব। কম্পিউটার সিডিসিকে বিরক্ত করে মারব। আমি আরেকটা ড্রিংকের কথা বললাম।
রোবট বলল, আমার মনে হয় আপনার এই ড্রিংকটা আর খাওয়া ঠিক হবে না।
আমি কঠিন গলায় বললাম, তোমার কী মনে হয় তা দিয়ে আমার জগৎ চলবে না। আমার জগৎ চলবে আমার নিয়মে। আমি আরেকটা ড্রিংক খাব। এবং খেতে খেতে গান করব। তুমি শুনবে। ভাল না লাগলেও শুনবে।
জি আচ্ছা।
পঞ্চম গ্লাসে চুমুক দিয়ে গান ধরলাম। এমিতে আমার সুর ভাল না, আজ দেখি সুন্দর সুর বের হচ্ছে। নোটগুলি গলায় বসে যাচ্ছে। আমি বেশ গলা খেলিয়ে গাইতে পারছি। আমি বিষাদময় একটা চন্দ্ৰগীতির অনেকখানি গেয়ে ফেললাম। মঙ্গলগ্রহে যে-সব মানুষ বসতি স্থাপন করেছে—এই চন্দ্রগীতি তাদের অত্যন্ত প্রিয়। মঙ্গলগ্রহের দুটি চাঁদ ডিমোস এবং ফিববাসে যখন একসঙ্গে জোছনা লাগে তখন তারা এই চন্দ্রগীতি গায়,