হলের সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের তাকানোর ভঙ্গিই বলে দিচ্ছে আমি ভয়াবহ কোন অন্যায় করে ফেলেছি। আমার কথা শেষ হবার পরও বেশ কিছু সময় কেউ কোন কথা বলল না। লিলিয়ান উঠে দাঁড়ালেন। হলের সবাই তার সঙ্গে উঠে দাঁড়াল। সবাই মিলে কি পিটি করছে নাকি? কী হাস্যকর। কী হাস্যকর। তিনি তাদের বসতে বললেন। সবাই বসল। লিলিয়ান আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কাউন্সিল অধিবেশনে বিনা অনুমতিতে কথা বলা অমার্জনীয় অপরাধ। এই বিষয়ে পরে সিদ্ধান্ত হবে। এখন মহামান্য সুরা তাঁর বক্তব্য শেষ করবেন।
সুরা বললেন, ইয়ায়ু বা মানুষ নামের এই ভদ্ৰলোক হচ্ছেন সেই ব্যক্তি যিনি দাবি করছেন তাকে জোর করে মহাকাশযানে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তিনি কোন ভলেন্টিয়ার না। বিষয়টির মীমাংসা হওয়া উচিত।
লিলিয়ান বললেন, বিষয়টির মীমাংসা হয়েছে। আমাদের সবার সামনে একটি ফাইল আছে সেই ফাইলের কাগজপত্রের দিকে আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। কাগজপত্রে ইয়ায়ু ভলেন্টিয়ার হিসেবে তাকে গ্রহণ করার বিনীত অনুরোধ জানিয়ে সায়েন্স কাউন্সিলে আবেদন করেছেন। কাগজে তার হাতের ছাপ আছে। চোখের রেটিনার ছাপও আছে। আমি এই ছাপের সঙ্গে কিছুক্ষণ আগে নেয়া ছাপ এফটু এনালাইজার দিয়ে মিলিয়েছি। একশ ভাগ মিল পাওয়া গেছে। অধিবেশনের এখানেই সমাপ্তি ঘোষণা করছি। মহামান্য সুরা মাঝে মাঝে তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে উত্তেজিত হন। আশা করি ভবিষ্যতে তিনি উত্তেজনা পরিহার করবেন। অবসর সময়টা গল্পের বই পড়ে কাটাচ্ছেন তা ভাল। সেইসব বই ক্রাইম-বিষয়ক না হওয়া বাঞ্ছনীয়।
সুরা বললেন, অধিবেশন শেষ করার আগে আমার আরেকটা তুচ্ছ বিষয় বাকি আছে। এই বিষয়টি উল্লেখ করতে চাই।
সবাই তাকিয়ে আছে সুরার দিকে।
লিলিয়ানের চোখেমুখে স্পষ্ট বিরক্তি। তিনি ভুরু কুঁচকে আছেন। তাঁর চোখ মুখে বাচ্চা ছেলেকে নিয়ে তো মহা যন্ত্রণায় পড়া গেল এরকম ভাব। অন্যদের ভেতর খানিকটা কৌতূহল দেখা যাচ্ছে। দুই মহান বিজ্ঞানীদের ছেলেমানুষি ঝগড়ার ব্যাপারটায় হয়ত তারা মজা পান। এখনো কিছু মজা পাবার অপেক্ষায় আছেন।
সুরা বললেন ব্যাপারটা ঘটল অবজারভেশন ডেকে। আপনারা হয়ত জানেন, অবজারভেশন ডেকে বসে গল্পের বই পড়তে আমার ভাল লাগে। এবং এও হয়ত জানেন পাঠক হিসেবে আমার রুচি খুবই নিম্নমানের। আমি সাধারণত হালকা ধরনের বই পড়ি। সাসপেন্স, থ্রিলার। প্রেমের উপন্যাসও পড়ি। কয়েকদিন আগে একটা বই শেষ করলাম—সিরিয়াস প্রেমের উপন্যাস। দুটা কম্পিউটারের মধ্যে প্রেম হয়ে গেল। একটা হল N-5 ধরনের কম্পিউটার অন্যটা QX কম্পিউটার। গভীর প্রেম হয়ে গেলেও N-5 কম্পিউটার বুঝতে পারছে যে প্রেম ব্যাপারটি তার হতে পারে না। এটা সম্পূর্ণ মানবিক আবেগের ব্যাপার। এবং মানব প্রজননের সঙ্গে সম্পর্কিত। N-5কম্পিউটার যখন তার অস্বাভাবিকতা বুঝল তখন সে স্বেচ্ছায় তার হার্ডডিস্ক নষ্ট করে ফেলল। অর্থাৎ বলা যেতে পারে সে আত্মহত্যা করল। QX কম্পিউটার তার প্রেমিকের আত্মহত্যা সহজভাবে নিতে পারল না। তার কাছে মনে হল এই নিঃসঙ্গ জীবন কিভাবে কাটাবে? সে একবার ভাবল নিজের হার্ডডিস্ক নষ্ট করবে, আরেকবার ভাবল করবে না। এই দুই বৈপরীত্যের মুখোমুখি দীর্ঘক্ষণ থাকায় তার লজিক-বোর্ড এলোমেলো হয়ে গেল। অর্থাৎ সে পাগল হয়ে গেল। গল্পটি ভাল। তবে QX টাইপ কম্পিউটারের লজিক-বোর্ড এলোমেলোর ব্যাপারটা একটু কষ্টকল্পিত। লেখক বলছেন লজিকবোর্ড এলোমেলো হওয়ায় বুলিয়ান এলজেব্রা…
লিলিয়ান বললেন, মহান সুরা কম্পিউটারের প্রেমের গল্প এখন কি না করলেই নয়? আমরা কি মূল প্রসঙ্গ থেকে সরে যাচ্ছি না?
স্রুরা বললেন, হ্যাঁ সরে যাচ্ছি। আমার কাজের ধারাই এমন। আমি মূল প্রসঙ্গ থেকে সরে থেকে কাজ করতে করতে মূল প্রসঙ্গে চলে আসি। পদার্থবিদ্যায় যে সব কাজ করার জন্যে আপনারা আমাকে মহান পদার্থবিদ বলছেন এবং সাতটা তারা গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছেন সেইসব কাজগুলি আমি এইভাবেই করেছি। আপনার কাজের ধারা ভিন্ন। আপনি মূল প্রসঙ্গ থেকে কখনো এক চুল সরেন নি। আমি আপনার মতো না। আমি দেখেছি বা বলতে পারেন আমার মনে হয়েছে বড় সমস্যাগুলি কেন্দ্রীভূত নয়। বড় সমস্যা কেন্দ্রের বাইরে ছড়িয়েছিটিয়ে থাকে।
যা-ই হোক মূল কথা হচ্ছে আমি অবজারভেশন ডেকে বই পড়ছিলাম। এই যে এই বইটা পড়ছিলাম। এমন সময় ইয়ায়ু বা মানুষ নামের এই ভদ্ৰলোক এলেন। আমার সঙ্গে তাঁর কিছু কথাবার্তা হল। ভদ্রলোককে আমার পছন্দ হল। খুবই পছন্দ হল। এটিও আমার একটা সমস্যা। যেই আমার সঙ্গে কথা বলে তাকেই আমার পছন্দ হয়। খুবই পছন্দ হয়। এমন কি মহান লিলিয়ানকেও আমার পছন্দ। খুবই পছন্দ।
হলঘরে চাপা হাসির শব্দ উঠেই থেমে গেল। আমি লক্ষ করলাম লিলিয়ানের চোখ-মুখ লাল হয়ে উঠেছে। বোঝাই যাচ্ছে ভদ্রমহিলা অত্যন্ত অপমানিত বোধ করছেন। তার চেহারা থেকে কাঠিন্য সরে গেছে এবং তার মধ্যে অসহায় ভাব চলে এসেছে। ভদ্রমহিলা যে কত সুন্দর তা এখনই শুধু বোঝা যাচ্ছে।
স্রুরা বললেন—লোকটি আমার পাশে বসল। আমরা গল্পগুজব করছি। যে বইটি আমি পড়ছি তার বিষয়বস্তুই হচ্ছে আলোচনার কেন্দ্র। তখন দ্রুত কিছু ঘটনা ঘটল। ঘটনাগুলো এ রকম
১. কম্পিউটার সিডিসি আলোচনায় অংশগ্রহণ করল।