ছড়াটি কি আপনি আমাকে শোনাবেন?
অবশ্যই শোনাব। ছড়াটা হল–
এলা এলা
চলে যাচ্ছে বেলা
কাজ হল মেলা
এখন শুধুই খেলা।
এলা বলল, স্যার আমি অত্যন্ত আনন্দিত।
একটু আগেই যে বললে তুমি আনন্দিতও হতে পার না, আবার দুঃখিতও হতে পার না।
স্যার মনে হয় ভুল বলেছি। এখন আমার আনন্দ হচ্ছে।
এর সঙ্গে আরো কিছুক্ষণ ফাজলামি করা যেত, তা করা গেল না। খাবারঘরে দপ করে লাল আলো জ্বলেই নিভে গেল। এই আলো হল মনযোগ আকর্ষণমূলক আলো। কেউ আমার মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করছে। আমি কান পেতে রইলাম।
ইয়ায়ু আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
সিডিসি কথা বলছে। আমাকেই বলছে, আমিই হলাম ইয়ায়ু। গাধাটা এই নাম কোত্থেকে জোগাড় করল? আমি গম্ভীর গলায় বললাম, কেন ইয়ায়ুর দৃষ্টি আকর্ষণ করছ?
কাউন্সিলের সামনে উপস্থিত হতে হবে।
কাউন্সিল আবার কী?
আপনি নিশ্চয়ই জানেন, কারণ আপনাকে বলা হয়েছে যে এই মহাকাশযানে পৃথিবীর অত্যন্ত খ্যাতনামা কিছু মানুষ আছেন। তাঁদের মধ্যে আছেন সাত তারকা সম্মানে সম্মানিত বিজ্ঞানী সুরা এবং লিলিয়ান। সাত তারা খচিত বিজ্ঞানীদের যে কোন তিনজন উপস্থিত থাকলেই তাঁরা কাউন্সিলের অধিবেশন ডাকতে পারেন। এবং তিনজন একমত হলে যে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। যদিও এই মহাকাশযানে তিনজন সাত তারা খচিত বিজ্ঞানী নেই, তার পরেও বিশেষ অধিবেশন ডাকার ক্ষমতা তাদের আছে। বিশেষ কাউন্সিল অধিবেশন ডাকা হয়েছে। মহাকাশযানের সকল সদস্যদের উপস্থিত হতে বলা হয়েছে।
অধিবেশন ডাকা হয়েছে কেন? আমাকে শাস্তি দেয়ার জন্যে? আবারো কোন গুরুত অপরাধ কি করে ফেলেছি?
আমি তা বলতে পারছি না। তবে এই অধিবেশন ডাকার মূল কারণ যে আপনি তা বলতে পারছি।
আমি হাই তুলতে-তুলতে বললাম, আমি এখন যেতে পারছি না। খাওয়াটা বেশি হয়ে গেছে। আঁসফাস লাগছে। ভাবছি এর সঙ্গে গল্পগুজব করার পর কিছুক্ষণ শুয়ে থাকব। গড়াগড়ি করব।
কাউন্সিল অধিবেশন ডাকা হয়েছে, আপনাকে উপস্থিত হতে বলা হয়েছে, আর আপনি বলছেন আপনি শুয়ে থাকবেন?
হ্যাঁ তা বলছি। বলাটা কি খুব অন্যায় হয়েছে?
আপনার সঙ্গে কথা বলে আমি সময় নষ্ট করতে চাচ্ছি না। আপনি এক্ষুণি হলঘরে যাবেন। শান্তি-রোবট আপনাকে নিয়ে যাবে।
হলঘর শুনলে মনে হয় বিশাল একটা ঘর। এ-মাথা থেকে ও-মাথা দেখা যায় না এমন। আসলে তা না, হলঘরটা বেশ ছোট এবং মহাকাশযানের বেশিরভাগ ঘরের মতো গোলাকার। মাঝখানে স্টেজের মতো জায়গায় যে দুজন বসে আছেন তাদের একজনকে চিনতে পারছি, তার নাম সুরা। অবাক হয়ে লক্ষ করলাম তাঁর হাতে ডিটেকটিভ বইটা এখনো আছে। এবং আমি যখন ঢুকলাম তখনও তিনি বইটা পড়ছিলেন। আমাকে একঝলক দেখেই বই-এ চোখ ফিরিয়ে নিলেন।
সুরার পাশে যিনি বসে আছেন তিনি নিশ্চয়ই লিলিয়ান। লিলিয়ান একজন মহিলা হবেন তা নাম থেকেই আমার আঁচ করা উচিত ছিল। আঁচ করতে পারি নি। সুরার চেহারায় যেমন শিশুসুলভ ব্যাপার আছে এই মহিলার চেহারায় তা নেই। দেখেই বোঝা যাচ্ছে তিনি কোনরকম ছেলেমানুষির প্রশ্রয় অতীতে দেন নি। ভবিষ্যতেও দেবেন না। মহিলা অসম্ভব রূপবতী, তবে চেহারা রুক্ষ ও কঠিন। তাঁর কাঠিন্য রূপকে ছাড়িয়ে গেছে। তা ছাড়া ভদ্রমহিলার চোখ অস্বাভাবিক তীক্ষ্ণ। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে এমন রূপবতী মহিলার প্রেমে কেউ কখনোই পড়বে না। ভেলেনটাইনস ডে তে ফুল এবং চকোলেট পাবার আশা এই মহিলার নেই।
হলঘরে সকল সদস্য মূর্তির মতো বসে ছিল। তাদের বসার জায়গাটা অনেকটা প্রাচীনকালের থিয়েটারের বক্সের মতো। সবাই আলাদা আলাদা খুপরিতে বসে আছেন। প্রতিটি খুপরি কাচ দিয়ে ঢাকা। কারোর সঙ্গে কারোর কোন যোগ নেই।
আমি হলঘরে ঢুকতেই সবাই আমার দিকে তাকাল। আমি বিনীতভাবে হাসলাম। কেউ সেই হাসির উত্তর দিল না। সবাই চোখ ফিরিয়ে নিয়ে আবার মূর্তির মতো হয়ে গেল। শুধু লিলিয়ান তাকিয়ে থাকলেন। হলঘরে খালি খুপরি আরো আছে। আমাকে কেউ বসতে বলল না বলে আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। নিজেকে ভয়াবহ কোন অপরাধীর মতো লাগছে। মনে হচ্ছে লিলিয়ান আমার বিচার করবেন। বাকি সবাই জুরি বোর্ডের মেম্বার। বিচারের রায়ে আমার মৃত্যুদণ্ড হবে। এ বিষয়ে কারো মত পার্থক্য থাকবে না, শুধু মৃত্যুদণ্ডটা কিভাবে হবে তা নিয়ে কথা কাটাকাটি হবে। কেউ বলবেন ইলেকট্রিক চেয়ার আবার কেউ বলবেন ইনজেকশন মেথড।
লিলিয়ান বললেন—(তাঁর গলার স্বরও চেহারার মতোই কঠিন, আমি মনে মনে আশা করেছিলাম তাঁর গলার স্বরটা মিষ্টি হবে।) কাউন্সিলের বিশেষ অধিবেশন শুরু হচ্ছে। মহামান্য সুরা! অধিবেশন আপনি ডেকেছেন। আপনার যা বলার তা বলুন।
সুরা উঠে দাঁড়ালেন। অন্য সবাই তাঁর সঙ্গে উঠে দাঁড়াল। সুরা হাতের ইশারায় বসতে বললেন। সবাই বসল। এটাই বোধহয় নিয়ম। আমার কাছে কেমন যেন হাস্যকর লাগছে। জ্ঞানী মানুষরা সবসময়ই কিছু হাস্যকর কাণ্ডকারখানা করেন।
সুরা বললেন, শান্তি-রোবটের পাশে যাকে আপনারা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখছেন তার নাম-ইয়ায়ু।
আমি হাত তুললাম এবং গলাখাকারি দিয়ে বললাম, স্যার আপনি সামান্য ভুল করছেন। আমার নাম ইয়ায়ু নয়। আমার নাম মানুষ। সম্ভবত আপনি ঘটনাটা ভুলে গেছেন। ভুলে যাওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। এটা এমন কোন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা না। আমি হলে চেহারাও ভুলে যেতাম। আপনি চেহারাটা মনে রেখেছেন এতেই আমি মহাখুশি।