ঘুম ভাঙার পর বেশিক্ষণ চোখ বন্ধ করে থাকা যায় না। ভেতর থেকে কে যেন বলতে থাকে, চোখ মেল। চোখ মেল।
আমি চোখ মেললাম। এবং হতাশ হয়ে দেখলাম সত্যি সত্যি আমার পাশে শান্তি-রোবটটা দাঁড়িয়ে আছে এবং হাসার মতো ভঙ্গি করছে। রোবটটার গালে প্ৰচণ্ড একটা চড় কলে কেমন হয়? সে তার উত্তরে কী করবে? আমার গালে প্ৰচণ্ড একটা চড় বসাবে? মনে হয় না। কারণ তাদের রাগ নেই। চড় খাবার পরেও আমার ধারণা সে বেশ স্বাভাবিকভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে। তার ঠোটের ফাকে আগের মতোই হাসির আভাস থাকবে।
আমি বিছানায় উঠে বসতে বসতে বললাম, তারপর তোমার খবর কি? সব ভাল তো?
রোবট কিছু বলল না। মানুষের মতো হ্যাঁ-সূচক মাথাও নাড়ল না। শুধু তার নীল চোখ একটু যেন বেশি জ্বলে উঠল।
তোমাকে কি আমার সঙ্গে সার্বক্ষণিকভাবে জুড়ে দেয়া হয়েছে?
আমাকে বলা হয়েছে আপনার দিকে লক্ষ রাখতে।
আমি ঘর থেকে বের হতে পারব না?
তা তো আমি বলতে পারব না। সিডিসি যদি অনুগ্রহ করে দরজা খুলে দেন তাহলে আপনি বের হতে পারবেন। তবে আপনি যেখানেই যান আমি আপনার দুমিটার দূরত্বে থাকব।
শুনে খুবই আনন্দিত হলাম। একমিটারের ভেতর থাকলে আরো ভাল হত। কী আর করা। দেখি হাতটা বাড়াও তো হ্যান্ডশেক করি।
আমি হাত বাড়িয়ে আছি। শান্তি-রোবটটা সেই হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। নিজের হাত বের করছে না। মনে হচ্ছে সে ধাঁধায় পড়ে গেছে।
আমি বললাম, মানবসমাজের অতি প্রাচীন নিয়মের একটি হচ্ছে দুজন যখন বন্ধুভাবাপন্ন হয়ে কাছে আসে তখন তারা একজন আরেকজনের হাত ধরে। এবং কিছুক্ষণ ঝাঁকাঝাঁকি বা নড়াচাড়া করে।
কেন?
ভাল প্রশ্ন করেছ। হাত না ধরে দুজন দুজনের পা বাড়িয়ে দিতে পারত। পায়ে পায়ে ঘষাঘষি করতে পারত। তা না করে কেন হাত ধরে তা আমি জানি না। মহাজ্ঞানী সিডিসিকে এক ফঁাকে জিজ্ঞেস করে জেনে নেব। তার আগে আমরা কি হ্যান্ডশেক করতে পারি?
রোবটটা তার হাত বাড়িয়ে দিল।
আমি তার হাত ধরতে-ধরতে বললাম, তোমার হাত তো বেকুবের মতো ধরলাম। এখন অটো সিস্টেমে তোমার হাত থেকে আমার হাতে সিরিঞ্জ ঢুকে যাবে না তো? বন্ধু পাতাতে গিয়ে শাঁ করে রক্তে ঘুমের ওষুধ ঢুকে গেল আর আমি ধড়াম করে বিছানায় পড়ে গেলাম। বাকি কয়েক ঘণ্টা আর কোন খবর নেই।
না তা হবে না।
আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দেবার সিদ্ধান্ত কি সিডিসি তোমাকে দেয়? নাকি তুমি নিজেই নাও?
এই সিদ্ধান্তটি সিডিসির কাছ থেকে আসে।
তাহলে তোমাদের গুরুদেব হচ্ছে মহাজ্ঞানী সিডিসি।
সবকিছুর মূল নিয়ন্ত্রণ তাঁর কাছে। এবং অবশ্যই তিনি মহাজ্ঞানী।
আমি হাই তুলতে-তুলতে বললাম, একটা মিথ্যাবাদীর হাতে তোমাদের সব নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে?
আপনি ভুল করছেন, কম্পিউটার মিথ্যা বলতে পারে না।
আমি হতাশ গলায় বললাম, কম্পিউটার মিথ্যা বলতে পারে কি পারে না তা আমি জানি না। আমি অতি সাধারণ মানুষ। মহাজ্ঞানীদের কেউ না। তবে আমি প্রমাণ করে দিতে পারি যে তোমাদের গুরুদেব মহা-মিথুক। যা-ই হোক প্রমাণ পরে করা যাবে। আপাতত আমি প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত। আমাকে কিছু খেতে হবে। তুমি মানুষ হলে তোমাকেও আমার সঙ্গে খেতে বলতাম। দুর্ভাগ্য যে তুমি মানুষ না। তুমি আমার জন্যে অপেক্ষা কর। আমি কিছু খেয়ে আসি। বেশি সময় লাগবে না। যাব আর আসব।
আমাকেও আপনার সঙ্গে যেতে হবে। আমি আগেই বলেছি আমাকে আপনার দুমিটারের মধ্যে থাকতে হবে। তার বেশিও না কমও না।
বেশ তো এসো আমার সঙ্গে। যে রোবটটি আমাকে খাবার দেয় সে বেশ। ভালমানুষ টাইপ রোবট। আমি আদর করে তার নাম দিয়েছি এলা। সে কারো শরীরে সুচ ঢুকায় না। তার সঙ্গে তোমার প্রেমও হয়ে যেতে পারে। না কি রোবটদের মধ্যে প্রেম হয় না?
শান্তি-রোবট জবাব দিল না। মনে হচ্ছে সে স্বল্পভাষী। সে কথার চেয়ে কর্মে বিশ্বাসী।
আমি খাবারঘরের দিকে রওনা হলাম।
টেবিলে আমার জন্যে খাবার সাজানোই ছিল। আমি কোন দিকে না তাকিয়ে আগে খানিকটা ফ্লেটিশ মাছের ডিম খেলাম। পরিজ-জাতীয় একটা খাবার খেলাম। এই খাবারটা আগে খাই নি। অত্যন্ত সুস্বাদ। মটরদানার তৈরি কিছু খাবার ছিল। খাবারটার বৈশিষ্ট্য হল—খেতে ভাল লাগে না। কিন্তু মুখের খাবারটা শেষ হয়ে গেলে আবারো খেতে ইচ্ছা করে। সেই অদ্ভুত খাবারও খাব না খাব না করে বেশ খানিকটা খেয়ে ফেললাম। পরপর দুকাপ গরম কফি খেলাম। শরীরটা মনে হল ঠিক হয়ে আসছে। এতক্ষণ মাথা ফাঁকা-ফাঁকা লাগছিল, সেই ফাঁকা ভাব কিছুটা যেন কমেছে।
এলার সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্পগুজব করলে কেমন হয়? শান্তি-রোবটটাকে তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়াও আমার সামাজিক দায়িত্ব। দুজনের মধ্যে প্রেম হলেও ক্ষতি কী?
এলা! জ্বি।
তোমাকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি—এ শান্তি-রোবট। অশান্তি-রোবট নাম হলে ভাল হত। এই শান্তি-রোবটের সবই ভাল—শুধু সুচ ফোটায়, তবে তোমাকে সুচ ফুটিয়ে কিছু করতে পারবে না। হা হা হা।
এলা বলল, আপনি মনে হয় খুব আনন্দে আছেন?
আমি হাসতে-হাসতে বললাম, ঠিক ধরেছ আমি আসলেই আনন্দে আছি। সেই আনন্দের উৎস কি ধরতে পারছি না। তুমি কেমন আছ? আনন্দে না নিরানন্দে?
আমরা আনন্দেও থাকি না, নিরানন্দেও থাকি না। আমরা শুধু থাকি।
তোমাকে নিয়ে আমি একটা ছড়া লিখেছি।
কখন লিখলেন?
এই এখন। ছড়াটা খুব উচ্চমানের হয় নি। নিম্নমানেরও হয় নি। নিম্নের নিচে যদি কিছু থাকে তা হয়েছে।