এখন আসল পরীক্ষাটি বাকী, এই প্রক্রিয়ায় সত্যিই কি জলাতঙ্কের প্রতিষেধক তৈরি করা সম্ভব? লুই পাস্তুর পরীক্ষা করে দেখতে শুরু করলেন। একটা কুকুরের মস্তিষ্কে প্রথমে বারো দিনের দুর্বল জীবাণু প্রবেশ করানো হলো। তারপর দিন এগারো দিনের জীবাণু তারপর দিন দশ দিনের জীবাণু। এভাবে প্রত্যেক দিনই আগের থেকে একটু বেশি ভয়ংকর জীবাণু কুকুরের মস্তিষ্কে ইনজেকশন দেয়া হয়েছে। বারো দিনের দিন একেবারে খাঁটি টগবগে জীবাণু কুকুরের মস্তিষ্কে ইনজেকশন দেয়া হলো। কিন্তু এতদিনে কুকুরটির দেহে জলাতঙ্কের প্রতিষেধক তৈরি হয়ে গেছে। এই ভয়ংকর জীবাণু নিয়েও সেটি বহাল তবিয়তে বেঁচে রইল। লুই পাস্তুর জলাতঙ্ক রোগের প্রতিষেধক বের করেছেন তবে মানুষের জন্যে নয় পশুর জন্যে।
ঠিক এ-রকম সময়ে নয় বছরের জোসেফ মাইস্টারকে নিয়ে তার মা এলেন লুই পাস্তুরের কাছে, আকূল হয়ে লুই পাস্তুরকে বললেন তার ছেলেকে বাঁচিয়ে দিতে। লুই পাস্তুর খুব চিন্তার মাঝে পড়ে গেলেন, নয় বছরের এই বাচ্চাটির শরীরে নিশ্চিতভাবেই জলাতঙ্ক রোগের জীবাণু ঢুকে গেছে, একজনের শরীরে জীবাণু ঢোকার পর তার শরীরে কী প্রতিষেধক তৈরি করা যাবে? যে প্রক্রিয়া কখনো কোনো মানুষের শরীরে পরীক্ষা করা হয় নি সেটি কি একটা শিশুর শরীরে পরীক্ষা করা যায়? অনেক ভেবেচিন্তে তিনি পরীক্ষাটি করার সিদ্ধান্ত নিলেন। প্রথমে দুই সপ্তাহ পরানো জীবাণু তারপর তেরো দিনের তারপর বারো দিনের। এভাবে যতই দিন যেতে লাগল ততই আগ্রাসী জীবাণু বাচ্চাটির শরীরে ঢুকিয়ে দেয়া হলো। একেবারে শেষ দিন তার শরীরে জলাতঙ্ক। রোগের যে জীবাণু ঢোকানো হলো সেটি অন্য যে কোনো পশু বা মানুষকে এক সপ্তাহের মাঝে মেরে ফেলার ক্ষমতা রাখে! সেই সময়টা সম্ভবত ছিল লুই পাস্তুরের জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময় তিনি খেতে পারেন না, ঘুমাতে পারেন না। লুই পাস্তুরের মাথায় শুধু একটা চিন্তা ছেলেটি কি বাঁচবে না মারা যাবে?
ছেলেটি মারা যায় নি। লুই পাস্তুরের চিকিৎসায় পৃথিবীর প্রথম জলাতঙ্ক রোগীটি বেঁচে উঠল। বিজ্ঞানের ইতিহাসে লুই পাস্তুরের এই অবিস্মরণীয় অবদানটি সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে!
জোসেফ মাইস্টার তার প্রাণ বাঁচানোর কারণে সারা জীবন লুই পাস্তুরের প্রতি কৃতজ্ঞ ছিল। সে বড় হয়ে লুই পাস্তুরের ল্যাবরেটরির দ্বাররক্ষীর দায়িত্ব নিয়েছিল। নাৎসি জার্মানি যখন ফ্রান্স দখল করে নেয় তখন নাৎসি বাহিনী লুই পাস্তুরের ল্যাবরেটরি দখল করতে আসে। জোসেফ মাইস্টার গেটের দরজায় দাঁড়িয়ে থেকে ল্যাবরেটরি রক্ষা করার চেষ্টা করে।
জার্মান সেনাবাহিনীর গুলিতে জোসেফ মাইস্টারের মৃত্যু হওয়ার আগে সে কাউকে ভিতরে ঢুকতে দেয় নি।
.
5. একটি অবিশ্বাস্য ঘটনা
1992 সালের 31 অক্টোবর, পৃথিবীর ইতিহাসে একটি অত্যন্ত চমকপ্রদ ঘটনা ঘটেছিল, সেদিন ক্যাথলিক চার্চ গ্যালিলিওকে ক্ষমা করে দিয়েছিল। সবাই নিশ্চয়ই এক ধরনের কৌতূহল নিয়ে জানতে চাইবে গ্যালিলিও একজন বিজ্ঞানী মানুষ, তিনি কী এমন অপরাধ করেছিলেন যে ক্যাথলিক চার্চের তাকে শাস্তি দিতে হয়েছিল? আর শাস্তি যদি দিয়েই থাকে তা হলে তাকে ক্ষমা করার প্রয়োজনটাই কী? আর ক্ষমা যদি করতেই হয় তাহলে তার জন্যে সাড়ে তিনশত বৎসর অপেক্ষা করতে হলো কেন?
এই প্রশ্নের উত্তরগুলোও প্রশ্নের মতোই চমকপ্রদ। বিজ্ঞানী গ্যালিলিও বলেছিলেন পৃথিবী এবং অন্যান্য গ্রহগুলো সূর্যকে ঘিরে ঘুরে। ক্যাথলিক চার্চের মনে হয়েছিল সেটা বাইবেল বিরোধী বক্তব্য এবং সেজন্যে তারা গ্যালিলিওকে শাস্তি দিয়েছিল!
এখন আমরা খুব সহজেই স্বীকার করে নিই যে পৃথিবীটা চ্যাপ্টা নয়, পৃথিবীটা গোল। যদিও দেখে মনে হয় চাঁদ সূর্য গ্রহ তারা পূর্বদিকে উঠে পশ্চিম দিকে অস্ত যায় আসলে সে-রকম কিছু ঘটে না, পৃথিবীটা নিজ অক্ষে ঘুরপাক খাচ্ছে বলে আমাদের সে-রকম মনে হয়। শুধু তাই নয় যদিও আমরা দেখছি পৃথিবীটা স্থির সূর্যটাই উঠছে এবং নামছে আসলে সেটা সত্যি নয়। বিশাল সূর্যটাকে ঘিরেই ছোট পৃথিবীটা ঘুরছে। কিন্তু একসময় সেটা মুখ দিয়ে উচ্চারণ করাও একটা ভয়ংকর রকমের অপরাধ ছিল।
আসলে ঝামেলেটি পাকিয়ে রেখেছিলেন অ্যারিস্টটল এবং টলেমির মতো দার্শনিক আর গণিতবিদরা। তারা বিশ্বাস করতেন পৃথিবীটাই সবকিছুর কেন্দ্র এবং সবকিছুই পৃথিবীকে ঘিরে ঘুরছে। তারা সেই সময় এত মহাজ্ঞানী ছিলেন যে, কেউ তাদের মতবাদকে অবিশ্বাস করেন নি। মোটামুটি সেই সময়েই অ্যারিস্টকাস নামে একজন অ্যারিস্টটল এবং টলেমির মতবাদকে চ্যালেঞ্জ করে বলেছিলেন যে, পৃথিবী সূর্যকে ঘিরে ঘুরে কিন্তু কেউ তার কথাটাকে এতটুকু গুরুত্ব দেয় নি।
অ্যারিস্টটল আর টলেমির ভুল ধারণা পৃথিবীর মানুষ প্রায় আঠারোশত বৎসর পর্যন্ত বিশ্বাস করে বসেছিল। টলেমির ব্যাখ্যাটি ছিল জটিল, যারা আকাশ-গ্রহ-নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করেন তাদের কাছে গ্রহগুলোর গতিবিধি ব্যাখ্যা করাটি ছিল সবচেয়ে কষ্টকর। এই ভুল ধারণাটি প্রথম চ্যালেঞ্জ করেন কোপার্নিকাস। তিনি দেখালেন যদি পৃথিবীর বদলে সূর্যকে কেন্দ্রস্থলে বসিয়ে দেয়া যায় তাহলে গ্রহ নক্ষত্রের গতিবিধি ব্যাখ্যা করা হয়ে যায় একেবারে পানির মতো সহজ। সবকিছু ব্যাখ্যা করে কোপার্নিকাস তার বইটি লিখেছিলেন 1530 সালে কিন্তু সেই বইটি প্রকাশ করতে সাহস পাচ্ছিলেন না। অনেক ভয়ে ভয়ে বইটি ল্যাটিন ভাষায় প্রকাশিত হয় 1543 সালে। কথিত আছে বইটি যখন কোপার্নিকাসের কাছে আনা হয় তখন তিনি সংজ্ঞাহীন এবং মৃত্যুশয্যায়।