জোসেফ মাইস্টারের মা তার ছেলেকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন। ডাক্তার তার ক্ষতস্থান পরিষ্কার করে বললেন, তার কিছু করার নেই। শেষ চেষ্টা হিসেবে বাচ্চাটাকে প্যারিসে লুই পাস্তুরের কাছে নেয়া যেতে পারে। সারা পৃথিবীতে শুধুমাত্র এই মানুষটিই যদি কোনো অলৌকিক উপায়ে বাচ্চাটার জীবন রক্ষা করতে পারেন, শুধু তাহলেই বাচ্চাটি বাঁচতে পারে। যে বিষয়টি সবচেয়ে বিচিত্র সেটি হচ্ছে লুই পাস্তুর কোনো ডাক্তার নন, তিনি একজন রসায়নবিদ। তার বয়স তখন তেষট্টি, স্ট্রোকে শরীরের অর্ধেক অবশ। জীবন সায়াহ্নে এসে পৌঁছে গেছেন কিন্তু তখনও সারা দেশের মানুষের তার ক্ষমতার উপর অগাধ বিশ্বাস!
লুই পাস্তুর খুব বড় একজন বিজ্ঞানী ছিলেন। বলা যায়, তাকে দিয়ে মাইক্রোবায়োলজি বা আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের শুরু হয়েছে। জীবাণু বা ব্যাক্টেরিয়ার অস্তিত্ব তার চাইতে ভালো করে কেউ জানে না কিন্তু তিনি এখন ভাইরাস নামের একটি অদৃশ্য শত্রুর সাথে যুদ্ধ করতে এসেছেন যেটা তখনো কেউ চোখে দেখে নি। বসন্ত রোগ বা জলাতঙ্ক রোগের কারণ হিসেবে বিজ্ঞানীরা এর অস্তিত্ব অনুভব করতে পেরেছেন কিন্তু সবচেয়ে শক্তিশালী মাইক্রোস্কোপ দিয়েও সেটাকে দেখতে পাওয়া যায় নি।
1880 সালে যখন লুই পাস্তুর তার অর্ধেক অবশ শরীর নিয়ে র্যাবিজ বা জলাতঙ্ক রোগের উপর গবেষণা শুরু করেছেন, তখন এটি সম্পর্কে মাত্র তিনটি বিষয় জানা ছিল, এক : র্যাবিজ আক্রান্ত পশুর লালায় এই ভাইরাসের অস্তিত্ব আছে, দুই : পশুর কামড়ে ক্ষতস্থান তৈরি হলে এই রোগের সংক্রমণ হয় এবং তিন : সংক্রমণের পর কয়েক দিন থেকে কয়েক সপ্তাহ পরে এই রোগের উপসর্গগুলো দেখা যায়। এর বাইরে পুরোটাই একটা রহস্য।
লুই পাস্তুর খাঁটি বিজ্ঞানীর মতো সমস্যাটি নিয়ে গবেষণা শুরু করলেন। প্রথমেই চেষ্টা করলেন জলাতঙ্কের কারণটি আলাদা করতে। একটা রোগ নিয়ে গবেষণা করতে হলে তার রোগীর প্রয়োজন তাই লুই পাস্তুরের প্রথম কাজ হলো নিয়ন্ত্রিতভারে পশুদের মাঝে জলাতঙ্ক রোগের সংক্রমণ করানো। বিপজ্জনক ঝুঁকি নিয়ে র্যাবিজ আক্রান্ত হিংস্র পাগলা কুকুরের মুখ থেকে লালা সংগ্রহ করে সেটা দিয়ে খরগোশ বা কুকুরকে আক্রান্ত করার চেষ্টা করে দেখা গেল এই পদ্ধতিটা খুব নির্ভরযোগ্য নয়। তা ছাড়া, সেটি ছিল খুব সময় সাপেক্ষ একটা ব্যাপার। একটা পশুর মাঝে রোগের উপসর্গ দেখা দিতে যদি মাসখানেক লেগে যায় তাহলে সেটা নিয়ে তো আর ল্যাবরেটরিতে গবেষণা করা যায় না। দ্রুত আক্রান্ত করার একটা পদ্ধতি বের করতে হবে।
লুই পাস্তুর চিন্তা করতে লাগলেন, রোগের উপসর্গ দেখে মনে হয় এটি স্নায়ুর রোগ, মস্তিষ্কের সাথে যোগাযোগ আছে। জলাতঙ্ক আক্রান্ত পশুর লালা না নিয়ে যদি স্পাইনাল কর্ডের অংশবিশেষ সরাসরি পশুর মস্তিষ্কে ইনজেশান দিয়ে প্রবেশ করিয়ে দেয়া হয়। তাহলে কী হয়? যেরকম চিন্তা সেরকম কাজ এবং সুই পাস্তুর আবিষ্কার করলেন তার ধারণা সত্যি। সরাসরি পশুর মস্তিস্কে ইনজেকশান দিয়ে খুব নির্ভরযোগ্যভাবে দ্রুত তিনি পশুকে র্যাবিজ রোগে আক্রান্ত করিয়ে দিতে পারছেন। এখন তিনি গবেষণার পরের ধাপে পা দিতে পারেন, রোগের কারণটিকে আলাদা করে বের করা।
এখানে এসে তিনি যেন এক শক্ত পাথরের দেয়ালের মাঝে ধাক্কা খেলেন। কিছুতেই এই অদৃশ্য কারণকে শনাক্ত করা যাচ্ছে না। একটা ব্যাক্টরিয়াকে কৃত্রিম পুষ্টি দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা যায়, বংশবৃদ্ধি বা কালচার করা যায় কিন্তু এই অদৃশ্য পরজীবী প্রাণটিকে কোনোভাবেই ল্যাবরেটরির টেস্টটিউবে বাঁচিয়ে রাখা যায় না। লুই পাস্তুর আবার খাঁটি বিজ্ঞানীর মতো ভাবলেন যদি তাকে কৃত্রিম অবস্থায় বাঁচিয়ে রাখা না-ই যায় তাকে তাহলে জীবন্ত কোথাও বাঁচিয়ে রাখা হোক। সেই জীবন্ত অংশটুকু হলো খরগোশের মস্তিষ্ক। আবার লুই পাস্তুরের ধারণা সত্যি প্রমাণিত হলো, খরগোশের মস্তিষ্কে এই অদৃশ্য জীবাণু শুধু বেঁচে থাকে না আরও ভয়ংকর আরও সর্বনাশী হয়ে উঠে, ছয়দিনের মাঝে এই রোগ তার সর্বগ্রাসী উপসর্গ নিয়ে দেখা দেয়।
লুই পাস্তুর এখন গবেষণার শেষ ধাপে এসে পৌঁচেছেন, এমন একটা প্রক্রিয়া খুঁজে বের করা যেটা দিয়ে এই রোগের প্রতিষেধক বের করা যায়। একদিন ল্যাবরেটরিতে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ করে দেখলেন তার একজন সহকারী জলাতঙ্ক আক্রান্ত একটা খরগোশের স্পাইনাল কর্ড কাচের ফ্লাস্কে ঝুলিয়ে রেখেছেন, কতদিন এই ভয়ঙ্কর জীবাণু বেঁচে থাকতে পারে সেটাই হচ্ছে পরীক্ষার উদ্দেশ্য। লুই পাস্তুর কাচের ফ্লাস্কের দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ করে চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেলেন, কিছুদনি আগেই মোরগের কলেরা রোগের ব্যাক্টেরিয়াকে অক্সিজেন দিয়ে দুর্বল করে ভ্যাক্সিন হিসেবে ব্যবহার করেছেন। এখানেও সেটি কি করা যায় না? যে অদৃশ্য জীবাণুকে তিনি দেখতে পাচ্ছেন না, কিন্তু যার অস্তিত্ত্ব নিয়ে কোন সন্দেহ নেই সেটাকে কী দুর্বল করে এর প্রতিষেধক হিসেবে ব্যবহার করা যায় না।
পৃথিবীর একজন শ্রেষ্ঠ ব্যবহারিক বিজ্ঞানী তখন কাজে লেগে গেলেন। খরগোশের স্পাইনাল কর্ডে বেঁচে থাকা জীবাণুকে অক্সিজেন দিয়ে দুর্বল করতে লাগলেন। প্রতিদিন সেখান থেকে একটা অংশ নিয়ে সেটাকে গুড়ো করে সুস্থ খরগোশের মাথার ইনজেকশন দিতে শুরু করলেন। যতই দিন যেতে লাগল এই ভয়ংকর জীবাণু ততই দুর্বল হতে শুরু করল, বারোদিন পর জীবাণু এত দুর্বল হয়ে গেল যে, সেটা সুস্থ প্রাণীকে সংক্রমণ করতেই পারল না!