আমাদের এই মানুষটির টাকা উপার্জনের বিষয়টি যদি একজন গণিতবিদকে বলে তাকে জিজ্ঞেস করা হতো তাহলে তিনি কিন্তু চট করে উত্তর দিতেন না। সম্ভবত ভুরু কুচকে বলতেন, “এর উত্তর আমি কেমন করে দেব? প্রথম সাতদিনের বিষয়টি আমাকে জানিয়েছ, প্রমাণ করেছ। অন্যগুলো তো কর নি!” আমরা সম্ভবত গলার রগ ফুলিয়ে তর্ক করতে চেষ্টা করব, বলব, “দেখতেই পাচ্ছি যতদিন যাচ্ছে তত টাকা উপার্জন করছে। কাজেই দিনের সংখ্যা যদি হয় n তাহলে টাকা উপার্জনের পরিমাণও হচ্ছে n” গণিতবিদ মৃদু হেসে বলতে পারেন, “কেন টাকা উপার্জনের পরিমাণ তো n + (n-1)(n-2)(n-3)(n-4)(n-5)(n-6)(n-7) হতে পারে।” আমরা তখন অবাক হয়ে আবিষ্কার করব এই ফর্মুলাটি প্রথম সাতদিন যথাক্রমে 1 থেকে 7 দিলেও অষ্টম দিনে দেবে 5048, আমার কথা কেউ বিশ্বাস না করলে n এর জন্যে সংখ্যাগুলো পরীক্ষা করে দেখতে পারে। এটাই হচ্ছে গণিত এবং বিজ্ঞানের পার্থক্য, নূতন নূতন পরীক্ষা-নিরীক্ষা পর্যাবেক্ষণ দিয়ে বিজ্ঞানের পরিবর্তন হতে পারে, গণিতের সেই সুযোগ নেই। আমরা গণিতকে সব সময় পূর্ণাঙ্গভাবে প্রমাণ করতে চাই যেটা একবার প্রমাণিত হয়ে থিওরেম হিসেবে গৃহীত হয়েছে সেটাকে কেউ আর অপ্রমাণিত করতে পারবে না। গণিতের উপরে সে জন্যে আমাদের এত ভরসা আর বিজ্ঞানকে বোঝার জন্যে ব্যাখ্যা করার জন্যে তাই আমরা গণিতকে এত সাহস নিয়ে ব্যবহার করি।
গণিতের বেলায় যখনই কিছু প্রমাণ করা হয় সেটি সব সময়েই একটা পূর্ণাঙ্গ এবং নিখুঁত প্রমাণ কিন্তু বিজ্ঞানের সূত্র সে-রকম নয়। সেটি অল্প কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা পর্যবেক্ষণ থেকে এসেছে, নূতন পর্যবেক্ষণ, নূতন পরীক্ষা-নিরীক্ষা কিংবা নূতন চিন্তাভাবনা থেকে বিজ্ঞানের একটা সূত্র পরিবর্তিত হয়ে যেতে পারে। এটা কি বিজ্ঞানের একটা দুর্বলতা? আসলে সেটি মোটেও দুর্বলতা নয়, সীমাবদ্ধতা নয় বরং সেটাই হচ্ছে এর সৌন্দর্য বা শক্তি। বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন প্রকৃতি যে নিয়মে চলছে সেই নিয়মটি সব সময়েই সহজ এবং সুন্দর, বারবার তারা সেটি দেখেছেন এবং তা বিশ্বাস করতে শিখেছেন। তারা সেই নিয়মটি খুঁজে বেড়াচ্ছেন, অল্প কিছু পর্যবেক্ষণ এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা দিয়ে বিশাল একটি অজানা জগৎকে ব্যাখ্যা করে ফেলছেন সেটি যে পৃথিবীর মানব সম্পদায়ের জন্যে কত বড় একটি ব্যাপার সেটি অনুভব করা খুব সহজ নয়।
গণিতের সূত্রকে প্রমাণ করার কিছু চমৎকার পদ্ধতি আছে তার একটা হচ্ছে কন্ট্রাডিকশন পদ্ধতি, ইংরেজি কন্ট্রাডিকশন শব্দটির বাংলা অর্থ হচ্ছে অসঙ্গতি এবং এই পদ্ধতিটি আসলেই গণিতের সূত্রকে প্রমাণ করার জন্যে অসঙ্গতিকে ব্যবহার করা হয়। এই পদ্ধতিতে কোনো একটা সূত্রকে প্রমাণ করার জন্যে প্রথমে কিছু একটা ধরে নেয়া হয়; সেখান থেকে যুক্তিতর্ক দিয়ে অগ্রসর হয়ে একটা অসঙ্গতির মাঝে হাজির হওয়া হয়–তখন বলা হয় প্রথমে যেটি ধরে নেয়া হয়েছে। সেটি নিশ্চয়ই ভুল তাই এই অসঙ্গতি! আমার মনে হয় একটি উদাহরণ দিলে ব্যাপারটি বোঝা সহজ হবে।
1 থেকে বড় যে পূর্ণ সংখ্যাকে 1 ছাড়া অন্য কোনো সংখ্যা দিয়ে পুরাপুরি ভাগ করা যায় না সেই সংখ্যাগুলোকে বলে প্রাইম সংখ্যা। 2, 3, 5, 7, 11, 13, 17… এগুলো হচ্ছে প্রাইম সংখ্যার উদাহরণ। 2 হচ্ছে সবচেয়ে ছোট প্রাইম সংখ্যা এবং সেটা একমাত্র জোড় প্রাইম। এখন পর্যন্ত পাওয়া সবচেয়ে বড় প্রাইম সংখ্যাটিতে প্রায় দুই কোটি ডিজিট রয়েছে, ছোট ছোট ছাপাতে লিখলেও পুরো সংখ্যাটি লিখতে প্রায় দশ হাজার পৃষ্ঠা লেগে যাবে। তবে এই প্রাইম সংখ্যার একটা বিশেষ বিশেষত্ব থাকায় এটাকে খুব ছোট করেও লেখা যায়, তাহলে সেটা হবে (2^32,582,657)-1, নিঃসন্দেহে অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত একটা রূপ! গণিতবিদ এবং অন্যান্য উৎসাহী মানুষেরা ক্রমাগত নূতন নূতন প্রাইম সংখ্যা বের করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। সংখ্যা যত বড় হয় প্রাইম সংখ্যা পাবার সম্ভাবনা তত কমে আসে কিন্তু তাই বলে প্রাইম সংখ্যা কখনই কিন্তু শেষ হয়ে যাবে না। ইউক্লিড দুই হাজার বছরেরও আগে এটা প্রমাণ করে গেছেন। কন্ট্রাডিকশন পদ্ধতির এই প্রমাণটি এত সহজ যে, যে কোনো মানুষই এটি বুঝতে পারবে। প্রমাণটি শুরু হয় এভাবে : ধরা যাক আসলে প্রাইম সংখ্যাগুলো অসীম সংখ্যাক নয়–অর্থাৎ, আমরা যদি সবগুলো প্রাইম সংখ্যা বের করতে পারি তাহলে দেখব একটা বিশাল প্রাইম সংখ্যা আছে এবং তার চাইতে বড় কোনো প্রাইম সংখ্যা নেই। সর্ববৃহৎ এবং সর্বশেষ এই প্রাইম সংখ্যাটি যদি Ph হয় তাহলে আমরা একটা মজার কাজ করতে পারি। পৃথিবীর যত প্রাইম সংখ্যা আছে তার সবগুলোকে গুণ করে তার সাথে 1 যোগ করে আমরা একটা নূতন সংখ্যা P তৈরি করতে পারি যেটা হবে:
P=P1xP2xP3x…..Pn+1
একটু লক্ষ করলেই আমরা বুঝতে পারব যে এই নূতন সংখ্যাটিকে কিন্তু কোনো সংখ্যা দিয়ে ভাগ করা যাবে না। যে কোনো প্রাইম সংখ্যা Pi, P, P; দিয়ে ভাগ করলে ভাগশেষ হবে 1। যেসব সংখ্যা প্রাইম নয় সেগুলো দিয়ে ভাগ করার প্রয়োজন নেই কারণ সেই সংখ্যাগুলোও আসলে প্রাইম দিয়েই তৈরি (যেমন 14=2×7, 30=2x3x5, 32=2x2x2x2x2)। যে সংখ্যাকে 1 ছাড়া অন্য কোন সংখ্যা দিয়েই ভাগ দেওয়া যায় না সেটা হচ্ছে প্রাইম সংখ্যা, কাজেই ইউক্লিড দেখিয়ে দিলেন যে যদি আসলেই সর্ববৃহৎ এবং সর্বশেষ একটা প্রাইম সংখ্যা থাকে তাহলে তার থেকেও বড় একটা প্রাইম সংখ্যা তৈরি করা যায়। সরাসরি একটা কন্ট্রাডিকশন বা অসঙ্গতি! এই অসঙ্গতি দূর করার জন্যে বলা যায় যে প্রথমে যে জিনিসটি ধরে আমরা শুরু করেছিলাম সেটিই ভুল অর্থাৎ সর্ববৃহৎ প্রাইম সংখ্যা বলে কিছু নেই। অর্থাৎ প্রাইমের সংখ্যা অসীম।