পৃথিবীর কক্ষপথ আর গ্রহাণুপুঞ্জের কক্ষপথ একটি আরেকটিকে ছেদ করে তাই মাঝে মাঝেই এধরনের ঘটনা ঘটবে। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল থাকার কারণে এই উল্কাগুলো মাটিতে পৌঁছানোর আগেই পুড়ে ছাই হয়ে যায়। উল্কাগুলোর আকার যদি বড় হয় তাহলে মাটিতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে পুড়ে শেষ হতে পারে না। বিজ্ঞানীদের হিসেবে প্রতি একশ বছরে একটা পঞ্চাশ থেকে ষাট মিটারের উল্কা পৃথিবীতে আঘাত করতে পারে। তবে তার বেশির ভাগই সমুদ্রে পড়বে, আমরা হয়তো বুঝতেই পারব না। প্রতি মিলিয়ন বছরে দশ কিলোমিটারের একটা সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত পৃথিবীতে নেমে আসতে পারে। সেটি যদি পৃথিবীতে আঘাত করে তার ফলাফল হবে ভয়ানক, পঁয়ষট্টি মিলিয়ন বছর আগে পৃথিবীর প্রাণিজগৎ সেটা টের পেয়েছিল। 1972 সালে এক হাজার টনের একটা উল্কা পৃথিবীর কাছাকাছি দিয়ে উড়ে গিয়েছিল। অল্পের জন্য সেটা পৃথিবীকে আঘাত করে নি। 1991 সালে প্রায় দশ মিটার বড় একটা গ্রহকণা পৃথিবী এবং চাঁদের মাঝখান দিয়ে উড়ে গিয়েছিল।
কাজেই ধরে নেয়া যেতে পারে মহাজাগতিক এধরনের সংঘর্ষ হওয়া এমন কিছু বিচিত্র নয়। রাতের আকাশে আমরা যখন হঠাৎ করে একটা উল্কাকে নীলাভ আলো ছড়িয়ে উড়ে যেতে দেখি তখন আমরা এক ধরনের বিস্ময় মেশানো আনন্দ অনুভব করি। কথিত আছে তখন মনে-মনে যে ইচ্ছাটা করা হয় সেটাই পূরণ হয়। কিন্তু হঠাৎ করে এই উল্কাগুলো যদি কয়েক কিলোমিটার বড় হয়ে যায় তাহলে পৃথিবীর পুরো সভ্যতা এক মুহূর্তে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। তাই পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা এই বিষয়টাকেও গুরুত্বের দিয়ে দেখছেন। পৃথিবীর কিছু বড় বড় টেলিস্কোপকে আকাশমুখী করা হয়েছে পৃথিবীর কক্ষপথে থাকা বিভিন্ন গ্রহকণাগুলো খুঁজে বের করতে। এ রকম একটি টেলিস্কোপ ছিল হাওয়াইয়ের মনাকীতে। সেটাই 1991 সালের দশ মিটার বড় গ্রহকণাটিকে খুঁজে বের করেছিল। স্পেস গার্ড নামে নূতন একটা প্রজেক্ট হাতে নেয়া হয়েছে, পঁচিশ বছরে পঞ্চাশ মিলিয়ন ডলার খরচ করে পৃথিবীর এক কিলোমিটারের কাছাকাছি সবগুলো গ্রহকণাকে খুঁজে বের করে তার তালিকা করা হচ্ছে। সেগুলোকে চোখে চোখে রাখা হবে। হঠাৎ করে কোনো একটা যদি পৃথিবীমুখী রওনা দেয় সেটাকে কীভাবে মহাকাশে নিউক্লিয়ার বোমা দিয়ে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয়া হবে সেটা নিয়েও গবেষণা হচ্ছে। এই মুহূর্তে আমাদের প্রযুক্তি হয়তো পুরাপুরি প্রস্তুত হয় নি, কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে আমাদের প্রযুক্তির উন্নতি হচ্ছে, কাজেই তখন সেটি এমন কিছু অসম্ভব কাজ বলে মনে হবে না।
১০. ভবিষ্যৎ
30. টাইম মেশিন
সময় সম্পর্কে আমাদের ধারণা আইনস্টাইন পাল্টে দিয়ে গিয়েছিলেন। একসময় ধারণা করা হতো সময় সবার জন্যে এক। আমার বয়স যদি এক বৎসর বাড়ে তাহলে আমার বন্ধু আমার পরিচিত সব মানুষজন এমনকি অপরিচিত সব মানুষের বয়সও এক বৎসর বেড়ে যাবে! কিন্তু আইনস্টাইন দেখিয়েছেন সেটা সত্যি নয়, যে মানুষটি বেশি ছোটাছুটি করছে তার বয়স একটু হলেও কম বেড়েছে, কারণ সময় সবার জন্যে এক নয়, যার যার সময় তার কাছে। আমরা বিষয়টা ধরতে পারি না কারণ পৃথিবীর মানুষ যারা ছোটাছুটি করে তাদের গতিবেগ খুবই কম, সুপারসনিক প্লেনে বড় জোর তারা শব্দের চেয়ে দ্রুতগতিতে যেতে পারে। কিন্তু সময়ের এই ব্যাপারটা চোখে পড়তে হলে একজনকে আলোর বেগের কাছাকাছি ছোটাছুটি করতে হবে। একজন মানুষ আলোর বেগের কাছাকাছি বেগে যেতে পারে না কিন্তু অনেক মহাজাগতিক কণা সহজেই সেটা পারে। এর সবচেয়ে চমকপ্রদ উদাহরণ হচ্ছে মিউওন, মহাজাগতিক কণা বায়ুমণ্ডলের উপরে আঘাত করে এই মিউওনের জন্ম দেয়। মিউওনের আয়ু খুবই কম। এই কম সময়ের ভেতরে একটা মিউওনের পুরো বায়ুমণ্ডল ভেদ করে পৃথিবীর পৃষ্ঠে উপস্থিত হওয়ার কোনো উপায় নেই, কিন্তু এটি সব সময় ঘটে থাকে (আমি একটা টাইম প্রজেকশন চেম্বার তৈরি করেছিলাম, সেখানে বসে বসে কংক্রীটের ছাদ, পুরু সীসার আস্তরন, ধাতব দেওয়াল সবকিছু ভেদ করে আসা মিউওনগুলো দেখতাম) বায়ুমণ্ডলের উপর থেকে পৃথিবীর পৃষ্ঠে আসতে যেটুকু সময় দরকার সেই সময়টুকু বেঁচে না থেকেই মিউওন কেমন করে চলে আসে তার ব্যাখ্যা খুবই সহজ। মিউওন তার হিসেবে বেঁচে থাকে ক্ষুদ্র একটি সময়, কিন্তু আমাদের সময়টি মিউওনের ব্যক্তিগত সময় থেকে ভিন্ন। যেটি অনেক দীর্ঘ। এই সময়ের ভেতর মিউওন দিব্যি বায়ুমণ্ডলের উপর থেকে পৃথিবী-পৃষ্ঠে চলে আসতে পারে।
সময় সম্পর্কে আমাদের কৌতূহল দীর্ঘদিনের। টাইম মেশিনে করে সময় পরিভ্রমণ করা সম্ভব কিনা সেটা নিয়ে অনেকেরই প্রশ্ন। সময় পরিভ্রমণ করে ভবিষ্যতে চলে যাওয়াটা তুলনামূলকভাবে সহজ। কেউ যদি একটা মহাকাশযানে করে প্রচণ্ড বেগে (আলোর বেগের কাছাকাছি) ছয় ঘণ্টা ভ্রমণ করে কোথাও যায় তারপর দিক পরিবর্তন করে আবার ছয় ঘণ্টা ভ্রমণ করে পৃথিবীতে ফিরে আসে, তা হলে সে দেখবে পৃথিবীতে হয়তো দশ বছর হয়ে গেছে। অর্থাৎ, সে দশ বছর ভবিষ্যতে চলে গেছে। এটি বিজ্ঞান কল্পকাহিনীর বিষয় নয়–এটি আইনস্টাইনের স্পেশাল থিওরি অফ রিলেটিভিটির ভবিষ্যদ্বাণী।
কিন্তু অতীতে কী যাওয়া সম্ভব? শুনে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে কিন্তু টাইম মেশিনে করে সময় পরিভ্রমণ করার ওপরে একাধিক বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র লেখা হয়েছে। কিপ থর্ন(১) নামে একজন পদার্থবিজ্ঞানী এই বিষয়ের উপর একটা গবেষণাপত্র (Wormholes, Time Machines, and The weak Energy Condition, Physical Review, Le Hers, 61, 1446, 1488) প্রকাশ করেছেন, যেটি সময় পরিভ্রমণের মতো একটি বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর বিষয়কে বৈজ্ঞানিক বিষয়ে পরিণত করেছে।