কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে আজ থেকে প্রায় ত্রিশ বৎসর আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আর.সি.এ. টেলিভিশন কোম্পানির একজন প্রযুক্তিবিদ একটা নূতন ধরনের টেলিভিশন আবিষ্কার করেছিলেন, সেখানে কেথড রে টিউব ব্যবহার করা হয় নি বলে টেলিভিশনটি ছিল পাতলা ফিনফিনে, ইচ্ছে করলেই দেওয়ালে ছবির ফ্রেমের মতো ঝুলিয়ে রাখা যেত। যুগান্ত কারী এই নূতন প্রযুক্তিটি মান্ধাতা আমলের অতিকায় টেলিভিশনগুলোকে অপসারণ করার কথা ছিল, কিন্তু সেটি ঘটে নি। আর.সি.এ. কোম্পানি ভেবে দেখল যে তারা প্রচলিত ধারার টেলিভিশন তৈরি করার জন্যে কোটি কোটি ডলার খরচ করে বিশাল ফ্যাক্টরি তৈরি করেছে। এখন এই নূতন ধরনের পাতলা ফিনফিনে টেলিভিশন তৈরি করতে হলে শুধু যে আবার কোটি কোটি ডলার দিয়ে নূতন ফ্যাক্টরি বসাতে হবে তা নয় সাথে সাথে আগের ফ্যাক্টরিটি অচল হয়ে যাবে। তারা ইতোমধ্যে প্রচলিত টেলিভিশনের একটা বাজার দখল করে রেখেছে সেটাও হাতছাড়া হয়ে যাবে–ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক রকম অর্থনৈতিক ঝামেলা। সবকিছু। চিন্তাভাবনা করে প্রযুক্তির এত চমৎকার একটা আবিষ্কারকে তারা আক্ষরিক অর্থে বাক্সবন্দি করে আবার আগের মতো পুরানো ধাঁচের টেলিভিশন তৈরি করতে লাগল। সেই বিজ্ঞানী ভদ্রলোকের কেমন আশাভঙ্গ হয়েছিল আমি সেটা খুব পরিষ্কার বুঝতে পারি ।
প্রায় দুইযুগ পরে সেই নূতন প্রযুক্তিটি আবার নূতন করে আবিষ্কার করা হয়েছে, আমরা সেটা ল্যাপটপ কম্পিউটারের স্ক্রীনে দেখতে শুরু করেছি। আগামী কিছুদিনের ভিতরে সেটি আবার টেলিভিশন আকারেও দেখতে পাব, তবে সময়ের বহু পরে।
এতক্ষণ পর্যন্ত আলোচনাটি হয়েছে একচক্ষু হরিণের মতো। প্রযুক্তি সম্পর্কে শুধু নেতিবাচক কথাই বলা হয়েছে কিন্তু কেউ যেন মনে না করে সেটাই একমাত্র কথা, অর্থাৎ বিজ্ঞানের তুলনায় প্রযুক্তিটি এত তুচ্ছ যে আমরা সব সময় সেটিকে শুধুমাত্র উপহাসই করব। প্রথমত, আমাদের বর্তমান এই সভ্যতাটি হচ্ছে প্রযুক্তির দেয়া একটি উপহার। বিজ্ঞানের গবেষণা করতে এখন প্রযুক্তিকে ব্যবহার করতে হয়, শুধু তাই নয় কিছুদিন আগে পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল পুরস্কার বিজ্ঞানীদের সাথে সাথে একজন ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারকে দেয়া হয়েছিল। তার কারণ যে যন্ত্রটি দিয়ে পরীক্ষাটি করা হয়েছে তিনি তার যান্ত্রিক সমস্যাটির সমাধান করে দিয়েছিলেন বলে পরীক্ষাটি করা সম্ভব হয়েছিল।
আমাদের চারপাশে প্রযুক্তির এত চমৎকার উদাহরণ আছে যে তার কোনো তুলনা নেই। আমরা সবাই ফাইবার অপটিক কথাটি শুনেছি। কাচ দিয়ে তৈরি চুলের মতো সূক্ষ্ম অপটিক্যাল ফাইবারের কোরটুকু এত ছোট যে সেটা মাইক্রোস্কোপ দিয়ে দেখতে হয়, এই ক্ষুদ্র একটিমাত্র কোরের ভেতর দিয়ে কয়েক কোটি মানুষের টেলিফোনে কথাবার্তা একসাথে পাঠানো সম্ভব। এই অসাধ্য সাধন তো প্রযুক্তিবিদেরাই করেছেন। অপটিক্যাল ফাইবারের ভেতর দিয়ে তথ্য পাঠানোর জন্যে আলোকে ব্যবহার করা হয়। আলোটি যেন কাচের ভেতরে শোষিত না হয়ে যায় সেজন্যে প্রযুক্তিবিদদের কাঁচটাকে স্বচ্ছ করতে হয়েছে। প্রথমে যখন শুরু করেছিলেন তখন এক কিলোমিটারে আলো শোষিত হতে 1000 ডিবি। প্রযুক্তিবিদরা পরিশোধন করে সেটাকে এত স্বচ্ছ করে ফেললেন যে এখন এক কিলোমিটার অপটিক্যাল ফাইবারে আলো শোষিত হয় মাত্র 0.25 ডিবি। কাঁচকে কতগুণ পরিশোধিত করতে হয়েছে সেটা যদি সংখ্যা দিয়ে লিখতে চাই তাহলে 1 এর পরে চারশত শূন্য বসাতে হবে! ( 1 এর পরে পাঁচটা শূন্য বসালে হয় লক্ষ, সাতটা শূন্য বসালে হয় কোটি কাজেই আমি যদি এটাকে কথায় বলতে চাই তাহলে বলতে হবে দশ কোটি কোটি কোটি কোটি … মোট সাতান্নবার!) পৃথিবীর ইতিহাসে এ-রকম আর কোনো উদাহরণ আছে বলে আমার জানা নেই!
কাজেই প্রযুক্তিকে বা প্রযুক্তিবিদদের কেউ যেন হেনা-ফেলা না করে। আমাদের নূতন পৃথিবীর সভ্যতাটুকু তারা আমাদের উপহার দিয়েছেন। কেউ যেন সেটা ভুলে না যায়। শুধু মনে রাখতে হবে পৃথিবীতে লোভী মানুষেরা আছে, অবিবেচক মানুষেরা আছে তারা অপ্রয়োজনীয় প্রযুক্তি কিংবা অমানবিক প্রযুক্তি দিয়ে পৃথিবীটাকে ভারাক্রান্ত করে ফেলতে পারে, জঞ্জাল দিয়ে ভরে তুলতে পারে।
পৃথিবীটাকে জঞ্জালমুক্ত করার জন্যে আবার তখন আমাদের বিজ্ঞানী আর প্রযুক্তিবিদদের মুখের দিকেই তাকাতে হবে। কারণ শুধু তারাই পারবেন আমাদের সত্যিকারের পৃথিবী উপহার দিতে।
.
3. বিজ্ঞান এবং বিজ্ঞানের ভাষা–গণিত
ধরা যাক একজন মানুষ কাজ করে প্রথম দিন এক টাকা উপার্জন করে এনেছে (আমরা জানি টাকার পরিমাণটা বেশি নয় কিন্তু যে ব্যাপারটা আলোচনা করতে যাচ্ছি সেখানে টাকার পরিমাণটা গুরুত্বপূর্ণ নয়)। সেই মানুষটা দ্বিতীয় দিনে এনেছে 2 টাকা, তৃতীয় দিনে 3 টাকা। এভাবে চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম দিনে এনেছে যথাক্রম 4, 5, 6 ও 7 টাকা। এখন আমরা যদি প্রশ্ন করি মানুষটি অষ্টম দিনে কত টাকা বাসায় এনেছে তাহলে মোটামুটি সবাই বলবেন আট টাকা। এটি যুক্তিসঙ্গত একটা উত্তর। তার টাকা উপার্জনে একটা প্যাটার্ন আছে, সেই প্যাটার্নটি কী আমাদের বলে দেয়া হয় নি কিন্তু তার উপার্জনের ধারাটি থেকে সেটা আমরা অনুমান করতে পারি। এটাই হচ্ছে বিজ্ঞান, পর্যবেক্ষণ করে পিছনের প্যাটার্নটি অনুমান করার চেষ্টা করা। যথেষ্ট পরিমাণ পর্যবেক্ষণ করা না হলে এই প্যাটার্ন বা নিয়মটি আমরা পুরাপুরি ধরতে পারি না, ভুলত্রুটি হতে পারে। বিজ্ঞান সেটি নিয়ে খুব মাথা ঘামায় না কারণ বিজ্ঞানের একটা সূত্র ঐশ্বরিক বাণীর মতো নয়, প্রয়োজনে সেটা পরিবর্তন করা যেতে পারে–প্রতিনিয়তই তা করা হচ্ছে।