জীবনকে আরামদায়ক করার কথা বলতে গিয়ে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরের কথা বলা হয়েছিল। শুধু যে ঘর তা নয়, ইরাকযুদ্ধের সময় আমরা জেনেছি সাজোয়া বাহিনীর জীপ ট্যাঙ্ক সবকিছুই এখন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত, যুদ্ধ করার সময় সৈনিকদের আর গরমে কষ্ট করতে হয় না। শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের জন্যে যে যন্ত্রপাতি তৈরি করা হয় কিংবা এরোসলে থাকে যে গ্যাস তার নাম ক্লোরোফ্লোরোকার্বন সংক্ষেপে সি.এফ.সি.। নিরীহ নামের সি.এফ.সি. গ্যাস কিন্তু মোটেও নিরীহ নয়, মানুষের তৈরি এই বিপজ্জনক গ্যাসটি ধীরে ধীরে বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়ছে তারপর উপরে উঠে বায়ুমণ্ডলে আমাদের প্রতিরক্ষার যে ওজোন আস্তরণ রয়েছে। সেটাকে কুড়ে কুড়ে খেতে শুরু করেছে। ওজোন আমাদের পরিচিত অক্সিজেন পরমাণু দিয়ে তৈরি। আমরা বাতাসের যে অক্সিজেনে নিশ্বাস নেই সেই অনুটি তৈরি হয়েছে দুটি অক্সিজেনের পরমাণু দিয়ে, আর ওজোন তৈরি হয়েছে তিনটি অক্সিজেনের পরমাণু দিয়ে। অক্সিজেন না হলে আমরা এক মুহূর্ত থাকতে পারি না কিন্তু ওজোন আমাদের জন্যে রীতিমতো ক্ষতিকর। কলকারখানা বা গাড়ির কালো ধোঁয়া থেকে অল্প কিছু ওজোন আমাদের আশপাশে আছে কিন্তু পৃথিবীর মূল ওজোনটুকু বায়ুমণ্ডলে 12 থেকে 30 মাইল উপর। ওজোনের খুব পাতলা এই আস্তরণটি সারা পৃথিবীকে ঢেকে রেখেছে, সূর্যের আলোতে যে ভয়ংকর আলট্রাভায়োলেট রশি রয়েছে ওজোনের এই পাতলা আস্তরনটুকু সেটা শুষে নিয়ে আমাদেরকে তার থেকে রক্ষা করে। ওজোনের এই পাতলা আস্তরণটা না থাকলে আলট্রা ভায়োলেট রশ্মি সরাসরি পৃথিবীতে পৌঁছে আমাদের সর্বনাশ করে ফেলতো।
কিন্তু সেই সর্বনাশটিই ঘটতে যাচ্ছে সি.এফ.সি দিয়ে। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল দিয়ে ভেসে ভেসে সি.এফ.সি যখন ওজোন আস্তরণে পৌঁছায় তখন একটা ভয়ংকর ব্যাপার ঘটে। আলট্রা ভায়োলেট রশ্মি সি.এফ.সি-কে ভেঙে তার ভেতর থেকে ক্লোরিন নামের একটা গ্যাসকে যুক্ত করে দেয়। এই ক্লোরিন গ্যাস ওজোনের সাথে বিক্রিয়া করে সেটাকে অক্সিজেনে পাল্টে দেয়। যে ওজোন আমাদের আলট্রা ভায়োলেট রশ্মি থেকে রক্ষা করতো সেটা না থাকার কারণে পৃথিবীতে সেই ভয়ংকর রশ্মি এসে আঘাত করতে শুরু করেছে। এক শতাংশ ওজোন কমে গেলে পৃথিবীতে দুই শতাংশ বেশি আলট্রাভায়োলেট রশ্মি পৌঁছাবে আর পৃথিবীর মানুষের ত্বকে ক্যান্সার হবে পাঁচ শতাংশ বেশি। শুধু যে ক্যান্সার বেশি হবে তা নয়, মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাবে–ম্যালেরিয়া, টাইফয়েড এ ধরনে রোগ হবে আরো অনেক বেশি। গাছপালাও দুর্বল হয়ে যাবে, সহজে বড় হতে চাইবে না। পৃথিবীতে ভয়াবহ একটা দুর্যোগ নেমে আসবে।
বিজ্ঞানীরা দেখেছেন ওজোনের আস্তরণটুকু ভয়াবহভাবে কমতে শুরু করেছে। শুধু যে কমতে শুরু করেছে তা নয় এন্টার্টিকার উপর ওজনের আস্তরণটি রীতিমতো ফুটো হয়ে গেছে–সেটি ছোট-খাটো ফুটো নয়, তার আকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমান। কী ভয়ংকর কথা! আমাদের জীবনযাত্রার একটু বাড়তি আরামের জন্যে এমন একটা প্রযুক্তি বেছে নিয়েছি যেটা পৃথিবীতে প্রাণী জগতের অস্তিত্বকে নিয়েই টান দিয়ে বসেছে। কেউ যেন মনে না করে এটিই একমাত্র উদাহরণ–এ-রকম উদাহরণ কিন্তু আরো অনেক আছে, দিয়ে শেষ করা যাবে না।
বিজ্ঞান নিয়ে কোনো সমস্যা হয় না কিন্তু প্রযুক্তি নিয়ে বড় বড় সমস্যা হতে পারে তার একটা বড় কারণ হচ্ছে বিজ্ঞানকে বিক্রি করা যায় না কিন্তু প্রযুক্তিকে বিক্রি করা যায়। আইনস্টাইন E = mc^2 বের করে একটি পয়সাও উপার্জন করেন নি (তার নোবেল প্রাইজটি এসেছিল ফটো ইলেকট্রিক এফেক্টের জন্যে) কিন্তু নিউক্লিয়ার বোমা বানানোর প্রতিযোগিতায় সারা পৃথিবীতে কত বিলিয়ন ডলার হাতবদল হচ্ছে সেটা কেউ চিন্তা করে দেখেছে? প্রযুক্তি যেহেতু বিক্রি করা যায় তাই সেটা নিয়ন্ত্রণ করে ব্যবসায়ীরা, বহুজাতিক কোম্পানিরা। পৃথিবীতে বহু উদাহরণ আছে যেখানে ব্যবসায়ীরা (বা কোম্পানিরা) তাদের টাকার জোরে একটা বাজে প্রযুক্তিকে মানুষের জীবনে ঢুকিয়ে দিয়েছে। মাত্র কিছুদিন হলো আমরা ভিসিডি ডিভিড়ি দিয়ে ভিডিও দেখতে শুরু করেছি। এর আগে ভিডিও দেখার জন্যে আমরা ভিডিও ক্যাসেট প্লেয়ারে ভি.এইচ.এস, ক্যাসেট ব্যবহার করতাম। প্রথম যখন এই প্রযুক্তিগুলো বাজারে এসেছিল তখন দু ধরনের ভিডিও ক্যাসেট ছিল। একটা হচ্ছে বেটা যেটা ছিল আকারে ছোট, আধুনিক এবং উন্নত। অন্যটি হচ্ছে ভি.এইচ.এস. যেটা আকারে বড়, অনুন্নত এবং বদখত । কিন্তু ভি.এইচ.এস, ক্যাসেটটি ছিল শক্তিশালী বহুজাতিক কোম্পানির এবং রীতিমতো জোর করে বাজারে ঢুকে সেটা উন্নত বেটা প্রযুক্তিটিকে বাজার ছাড়া করে ফেলল। প্রযুক্তির বেলায় দেখা যায় কোনটি উন্নত সেটি বিবেচ্য বিয়য় নয়, কোন কোম্পানির জোর বেশি সেটাই হচ্ছে বিবেচ্য বিষয়।
ব্যবসায়িক কারণে শুধু যে নিচু স্তরের প্রযুক্তি বাজার দখল করে ফেলে তা নয়, অনেক সময় অনেক আধুনিক প্রযুক্তিকেও ইচ্ছে করে বাক্সবন্দি করে রাখা হয়। এর সবচেয়ে ভালো উদাহরণটি টেলিভিশনকে নিয়ে। বর্তমান পৃথিবীতে টেলিভিশন দেখে নি সেরকম মানুষ মনে হয় একজনও নেই। সবারই নিশ্চয়ই টেলিভিশন নিয়ে একটা নিজস্ব মতামত আছে। তবে টেলিভিশনের যে বিষয়টি নিয়ে কেউ বিতর্ক করবেন না সেটি হচ্ছে তার আকারটি নিয়ে। টেলিভিশনের আকারটি বিশাল। টেলিভিশনের ছবি দেখা যায় সামনের স্ত্রীনটিতে, তাহলে শুধু সেই স্ক্রীনটাই কেন টেলিভিশন হলো না তাহলে সেটা জায়গা নিতো অনেক কম এবং আমরা ছবির ফ্রেমের মতো সেটাকে ঘরের দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখতে পারতাম। যারা এসব নিয়ে একটু-আধটু চিন্তা-ভাবনা করেছেন তারা জানেন টেলিভিশনের প্রযুক্তিটি তৈরি হয়েছে কেথড রে টিউব দিয়ে। এই টিউব পিছন থেকে টেলিভিশনের স্ক্রীনে ইলেকট্রন ছুঁড়ে দেয়, বিদ্যুৎ এবং চৌম্বক ক্ষেত্র দিয়ে সেই ইলেকট্রনকে নাড়া চাড়া করে টেলিভিশনের স্ক্রীনে ছবি তৈরি করা হয়। ইলেকট্রনকে আসার জন্যে স্ক্রীনের পিছনে অনেকখানি জায়গা দরকার, টেলিভিশনটা তাই ছোট হওয়া সম্ভব নয়।