একশ বছর আগে আইনস্টাইনের দেয়া এই সূত্র দুটি হচ্ছে আজকে সবার পরিচিত আপেক্ষিক সূত্র বা থিওরি অফ রিলেটিভিটি। এই সূত্র দুটি আমাদের পরিচিত পদার্থবিজ্ঞানের জগতে যে আলোড়নের সৃষ্টি করেছিল একশ বছর পরেও সেই আলোড়ন শেষ হয় নি। আইনস্টাইনের সেই যুগান্তকারী আপেক্ষিক সূত্রের একশ বছর পূর্তি উপলক্ষে 2005 সালে সারা পৃথিবীতে খুব হইচই করে সেটা পালন করা হয়েছে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো এত বড় যুগান্তকারী একটি সূত্র, কিন্তু সেটি বুঝতে যে গণিতের প্রয়োজন হয় সেটি ছাত্রছাত্রীরা স্কুলেই শিখে ফেলে, তার জন্যে আলাদা কিছু শিখতে হয় না!
আমরা আপেক্ষিক সূত্রটি ব্যাখ্যা না করে তার কারণে কী কী দেখা যায় সেটা নিয়ে আলোচনা করি। ধরা যাক আমি দাঁড়িয়ে আছি এবং আমার মাথার উপর দিয়ে একটা রকেট উড়ে গেল। রকেটের গতিবেগ যদি খুব বেশি না হয় তাহলে আমি রকেটটার মাঝে বিচিত্র কিছু দেখব না। কিন্তু রকেটটা যদি আলোর বেগের কাছাকাছি একটা গতি বেগে পৌঁছাতে পারে তাহলে আমি সবিস্ময়ে আবিষ্কার করব রকেটটা যেন সংকুচিত হয়ে গেছে (18.3 নং ছবি)! এখানে আরও মজার একটি ব্যাপার ঘটে। ধরা যাক রকেটের ভেতরে একজন মহাকাশচারী বসে আছে এবং সে আমাকে তাকিয়ে দেখছে, সে যেহেতু রকেটে বসে আছে তার কাছে মনে হবে রকেটটাই স্থির এবং রকেটের তুলনায় আমিই যেন বিশাল গতিবেগে ছুটছি। তাই সে দেখবে রকেট নয়, আমি সংকুচিত হয়ে গেছি! কেউ যেন মনে না করে এগুলো গাল-গল্প, বিজ্ঞানীরা ল্যাবরেটরিতে রীতিমতো পরীক্ষা করে এই বিষয়গুলো সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছেন।
এটি তো হলো চলন্ত বস্তুর দৈর্ঘ্যের সংকোচন, সময় নিয়ে যেটা হয় সেটা আরও অনেক বেশি চমকপ্রদ। আগে আমাদের ধারণা ছিল সময় সব জায়গায় সমান। আইনস্টাইনের আপেক্ষিক সূত্রটি একটু বিশ্লেষণ করলে অত্যন্ত চমকপ্রদ একটা সত্য বের হয়ে আসে, সেটা হচ্ছে চলন্ত বস্তুর সময়ের প্রসারণ (Time dilation)। বিষয়টা একটা উদাহরণ দিয়ে বোঝানো সবচেয়ে সহজ।
ক্যালিফোরনিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে (caltech) থাকাকালীন সময়ে আমি টাইম প্রজেকশান চেম্বার নামে একটি ডিটেক্টর তৈরি করেছিলাম, সেটা ঠিকভাবে কাজ করছে কি না দেখার জন্যে আমি যে জিনিসটা ব্যবহার করতাম তার নাম হচ্ছে মিউওন (Muon)। এমনিতে মিউওনকে পাওয়া যায় না কারণ তার আয়ু হচ্ছে মাত্র দুই মাইক্রোসেকেণ্ড (দুই সেকেন্ডের দশ লক্ষ ভাগের এক ভাগ) কোথাও এটা তৈরি হওয়ার দুই সেকেন্ডের মাঝে এটা শেষ হয়ে যায়। তবে পৃথিবীতে তার অভাব নেই কারণ প্রচণ্ড শক্তিশালী মহাজাগতিক রশ্মি প্রতিনিয়ত পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলকে আঘাত করছে এবং সেই আঘাতে মিউওনের জন্ম হচ্ছে। তবে সমস্যা হচ্ছে এই মিউওনগুলোর জনা হয় পথিবী থেকে একশ কিলোমিটার উপরে বায়ুমণ্ডলের প্রান্ত সীমানায়। তারা যে গতিবেগে আসে (আলোর গতিবেগের বেশ কাছাকাছি) তাতে পৃথিবী পর্যন্ত পৌঁছাতে সময় লাগে প্রায় তিনশত মাইক্রোসেকেন্ড। যে জিনিসটার আয়ু মাত্র দুই মাইক্রোসেকেন্ড সেটা কেমন করে তিনশত মাইক্রোসেকেন্ড পর্যন্ত টিকে থাকে? বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের আপেক্ষিক সূত্রের আগে এই রহস্যের কোনো ব্যাখ্যা ছিল না। এখন আমরা কারণটি জানি। একটি মিউওন তার নিজস্ব ইনারশিয়াল রেফারেন্স ফ্রেমে কিন্তু তার আয়ু মাত্র দুই মাইক্রো সেকেন্ডই বেঁচে থাকে। কিন্তু আমাদের কাছে সেই সময়টা অনেক দীর্ঘ, তিনশ মাইক্রোসেকেন্ড। কাজেই ক্যালিফোরনিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির বেসমেন্টে বসানো আমার সেই ডিটেক্টারে আমি এক ধরনের মুগ্ধ বিস্ময়ে নিয়ে মিউওনগুলোকে দেখতাম। বায়ুমণ্ডলের একেবারে উপরে জন্ম নিয়ে, প্রচণ্ড শক্তিতে বায়ুমণ্ডল, বিল্ডিংয়ের ছাদ, ডিটেক্টরের ধাতব দেয়াল সবকিছু ভেদ করে চলে যেত। এই মিউওনগুলোকে আমি দেখতাম কারণ তাদের সময়টি প্রসারিত হয়ে গেছে!
আপেক্ষিক সূত্রের এই বিষয়টি আমাদের জন্যে অনেক রহস্যের জন্ম দিয়েছে। একজন মানুষ যদি কোনো মহাকাশযানে করে সূদুর মহাকাশে পাড়ি দেয়, তার গতিবেগে যদি আলোর কাছাকাছি হয় তাহলে সে হয়তো বছর দশেক পর ফিরে এসে আবিষ্কার করবে এই দশ বছরে পৃথিবীতে এক হাজার বৎসর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। তার পরিচিত পৃথিবীর কিছুই আর নেই!
বিজ্ঞান কল্পকাহিনীর লেখকেরা বিজ্ঞানের কাল্পনিক গল্প লিখেন, কিন্তু সত্যিকারের কাহিনী যে কল্পনা থেকেও একশ গুণ বেশি চমকপ্রদ সেটা কী কখনো ভেবে দেখেছেন?
.
19. বিগ ব্যাং : একটি নাটকীয় বিষয়
যারা ট্রেন লাইনের পাশে দাঁড়িয়ে একটা চলন্ত ট্রেনকে হুইসেল দিতে দিতে আসতে শুনেছে তারা নিশ্চয়ই একটা ব্যাপার লক্ষ করেছে। ট্রেনটা যখন এগিয়ে আসতে থাকে তখন হুইসেলটা শোনায় একরকম (তীক্ষ) এবং যখন ছেড়ে চলে যেতে থাকে তখন শোনায় অন্যরকম (ভেঁতা)। তার কারণ হুইসেলের শব্দটা এক ধরনের তরঙ্গ, ট্রেন যখন সেই তরঙ্গটা ছাড়তে ছাড়তে এগিয়ে আসে তখন তরঙ্গ দৈর্ঘ্যটা একটু কমে আসে। তাই হুইসেলের শব্দটা শোনায় তীক্ষ্ম । আবার ট্রেনটা যখন তরঙ্গটা ছাড়তে ছাড়তে দূরে সরে যেতে থাকে তখন তরঙ্গ দৈর্ঘ্যটা একটু বেড়ে যায় তাই শব্দটা একটু ভোঁতা হয়ে আসে। তরঙ্গ যেখান থেকে আসছে তার গতির সাথে তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেড়ে যাওয়া এবং কমে যাওয়ার এই প্রক্রিয়াটার নাম হচ্ছে ডপলার এফক্ট (19.1 নং ছবি)।