যেমন ধরা যাক ট্রেনে যাবার ব্যাপারটি। স্টেশনে ট্রেন এসে থেমেছে, এখন আমরা ট্রেনে উঠব। ট্রেনটা যেহেতু থেমেছে তার অর্থ গতিবেগ হচ্ছে শূন্য অর্থাৎ গতিবেগটা আমরা নিশ্চিতভাবে জেনে গেছি। ট্রেনের জন্যে কোয়ান্টাম মেকানিক্স সত্যি হলে বলা যেত এখন আমরা যেহেতু গতিবেগটা নিশ্চিতভাবে জেনে গেছি তাই তার অবস্থান সম্পর্কে কিছুই জানব না! ট্রেনটি কী ঢাকা না কুমিল্লা না চট্টগ্রাম কোথায় আছে জানার কোনো উপায় নেই। এবারে উল্টোটাও হতে পারে। ধরা যাক আমরা নিশ্চিতভাবে জানি ট্রেনটা আখাউড়া রেলস্টেশনে, এখন কি আমরা ট্রেনে উঠতে পারব? মোটেও নয়, যেহেতু অবস্থানটা জেনে গেছি তাই এর গতিবেগ সম্পর্কে কিছুই জানব না। হয়তো ট্রেনটা ভয়ংকর গতিতে ছুটে যাচ্ছে সেটাতে উঠতে গিয়ে একেবারে ছাতু হয়ে যাব!
আমি নিশ্চিত অনেকেই আমাকে অবিশ্বাস করছেন–ট্রেনের ব্যাপার হলে অবিশ্বাস করতেই পারে। কিন্তু ক্ষুদ্র একটা পরমাণুর ব্যাপার হলে এর মাঝে অবিশ্বাস করার কিছু নেই, এটা সব সময়েই ঘটছে। কেন ঘটছে সেটা বোঝাও খুব সহজ, একটা সহজ উদাহরণ দিয়ে বোঝানো যায়। ধরা যাক একটা ইলেকট্রন যাচ্ছে–ইলেকট্রন খুব ছোট, ট্রেনের মতো বিশাল নয় তাই তার বেলায় কোয়ান্টাম মেকানিক্স শতভাগ সত্যি। কাজেই নিশ্চয়ই অনিশ্চয়তার সূত্রটিও সত্যি হবে অর্থাৎ, তার অবস্থান সম্পর্কে জানলে গতিবেগ (আসলে ভরবেগ) সম্পর্কে অনিশ্চিত হয়ে যাব। কেউ মনে করতে পারে কেন এটি হবে? খুব ছোট একটা মাইক্রোস্কোপ দিয়ে দেখে তো অবস্থান সম্পর্কে জানাই যায়। তাতে তার বেগ অনিশ্চিত হবে কেন? আসলে “দেখা” মানে হচ্ছে প্রতিফলিত আলো থেকে তথ্য বের করা কাজেই কোনো কিছুকে দেখতে হলে তার উপর আলো পড়তে হবে, সেই আলো মাইক্রোস্কোপে ফিরে আসতে হবে। মজার ব্যাপারা হচ্ছে ইলেকট্রন এত ছোট যে তাকে দেখার জন্যে আলোর ফোটন যখন তাকে আঘাত করে সেই আঘাতেই তার গতিবেগ ওলট পালট হয়ে যায়। (17.3 নং ছবি) কাজেই ইলেকট্রন কোথায় আছে সেই তথ্যটা আমরা জানতে পারলাম সত্যি কিন্তু সেটা জানার কারণে তার গতিবেগ পুরোটাই ওলট-পালট হয়ে গেল। আমরা যে জগৎকে সব সময় দেখি সেটি ক্ষুদ্র জগৎ নয় তাই অনিশ্চয়তার সূত্র নিয়ে আমাদের দুশ্চিন্তা করতে হয় না। কিন্তু পুরমাণু বা ফোটনের যে নিজস্ব ক্ষুদ্র জগৎ আছে সেখানে এটা কিন্তু একেবারেই নিত্তনৈমিত্তিক ব্যাপার।
পৃথিবীর সব বিজ্ঞানীই তে কোয়ান্টাম মেকানিক্স নিয়ে খুব স্বস্তি বোধ করেন তা নয়–মহাবিজ্ঞানী আইনস্টাইন কখনোই কোয়ান্টাম মেকানিক্সকে সুনজরে দেখেন নি (যদিও তিনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন ফটো ইলেকট্রিক এফেক্ট ব্যাখ্যা করে, যেটি ছিল আলোর ফোটন হিসেবে পরিচিতির ব্যাখ্যা!)। কিন্তু বিজ্ঞানীরা অসংখ্যবার অসংখ্যভাবে পরীক্ষা করে কখনই কোয়ান্টাম মেকানিক্সকে তার জায়গা থেকে বিচ্যুত করতে পারেন নি!
কে জানে হয়তো ভবিষ্যতে প্রকৃতির নূতন কোনো গোপন রহস্য আমাদের চোখে নূতনভাবে উন্মোচিত হবে। যেখানে থেকে পুরো বিষয়টি অন্যভাবে দেখা হবে! যতদিন সেটি হচ্ছে ততদিন কোয়ান্টাম মেকানিক্সকে নিয়েই আমাদের বেঁচে থাকবে হবে।
.
18. থিওরি অফ রিলেটিভিটি
1905 সালে বিজ্ঞানী আইনস্টাইন দুটি সূত্র দিয়েছিলেন। সূত্র দুটি এত সহজ যে একজন শিশুও সেটা বুঝতে পারবে। সূত্রদুটি এরকম : (এক) পদার্থবিজ্ঞানের সব সূত্র সকল ইনারশিয়াল রেফারেন্স ফ্রেমে (inertial reference Frame) একই থাকবে। (দুই) আলোর গতি সব ইনারশিয়াল রেফারেন্স ফ্রেমে সমান।
সূত্র দুটি লেখার জন্যে “ইনারশিয়াল রেফারেন্স ফ্রেম” নামে একটা ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, এটাকে বাংলায় অনুবাদ করা হলে শব্দটি এত কটমটে হয়ে যাবে যে এটাকে ইংরেজি রেখেই বরং বিষয়টি বুঝিয়ে দেয়া ভালো। ধরা যাক আমি ল্যাবরেটরিতে বসে পদার্থবিজ্ঞানের কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছি, তাহলে আমি বলতে পারি আমার ল্যাবরেটরিটি একটি ইনারশিয়াল রেফারেন্স ফ্রেম। এবারে ধরা যাক আমার হঠাৎ ইচ্ছে হলো আমি ট্রেনে বসে পদার্থবিজ্ঞানের পরীক্ষা-নিরীক্ষাগুলো করব যদি ট্রেনটা সমবেগে যায় তাহলে এই ট্রেনটাও একটা ইনারশিয়াল রেফারেন্স ফ্রেম। এখানে মনে রাখতে হবে ল্যাবরেটরি ঘরে বসে যে জিনিসটাকে স্থির মনে হয়েছিল ট্রেনে বসে সেটাকে মনে হবে উল্টোদিকে ছুটছে। ল্যাবরেটরি এবং ট্রেন এই দুটি ইনারশিয়াল রেফারেন্স ফ্রেমে একটা বস্তুকে কিন্তু একভাবে দেখা গেল না তাহলে আইনস্টাইনের প্রথম সূত্রটি সত্যি হলো কেমন করে? সূত্রটি একটু ভালো করে দেখতে হবে। আইনস্টাইন বলেন নি সবকিছু এক রকম দেখাবে, তিনি বলেছেন পদার্থবিজ্ঞানের সব সূত্র এক থাকবে। কাজেই আমি যদি ল্যাবরেটরিতে দেখি বল প্রয়োগ করলে ত্বরণ হয়, কিংবা তাপ প্রয়োগ করলে গ্যাসের চাপ বেড়ে যায় তাহলে চলন্ত ট্রেন থেকেও সেটা দেখব। পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রগুলো এক থাকবে, পর্যবেক্ষণগুলো ভিন্ন হতে পারে।
আইনস্টাইনের দ্বিতীয় সূত্রটি বরং একটু বিচিত্র, সেটি বলছে ইনারশিয়াল রেফারেন্স ফ্রেমে আলোর বেগ সমান। আমরা দৈনন্দিন জীবনে বেগ নিয়ে যেসব ব্যাপার দেখে অভ্যস্ত আইনস্টাইনের এই সূত্রটির তার সাথে মিল নেই। আমরা যখন কোথাও যাবার জন্যে ট্রেনে উঠি তখন অনেক সময়েই যারা বিদায় দিতে আসে তারা প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে ট্রেনের জানালা দিয়ে গল্প করে। ট্রেন যখন চলতে শুরু করে তখন শেষ মুহূর্তে দু একটি কথা বলতে হলে প্লাটফর্মের মানুষটিকে ট্রেনের সাথে সাথে হাঁটতে শুরু করতে হয়। ট্রেনের জানালা দিয়ে তাকালে আমাদের তখন মনে হবে ট্রেনের তুলনার মানুষটিও বুঝি দাঁড়িয়ে আছে! ট্রেন থেমে মাথা বের করে অনেক সময়েই আমরা পাশাপাশি রাস্তার একটা গাড়িকে যেতে দেখেছি, গাড়িটা আর ট্রেনটা যদি একই দিকে যায় তাহলে মনে হয় গাড়িটা ধীরে ধীরে যাচ্ছে! এটি হচ্ছে আমাদের পরিচিত আপেক্ষিক গতি একটির তুলনায় আরেকটার গতি। এটা বের কারাও সহজ একটা থেকে অন্যটা বিয়োগ দিলেই হয়। আইনস্টাইন তার সূত্রে বলেছেন সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা, তিনি বলেছেন আলোর বেলায় আমাদের পরিচিত আপেক্ষিক গতি কাজ করে না। আমি যদি কোথাও দাঁড়িয়ে থেকে দেখি আলো ছুটছে সেকেন্ডে এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল বেগে তাহলে একটা চলন্ত ট্রেন থেকেও তাই দেখব। শুধু যে সমবেগে চলতে থাকা একটা চলন্ত ট্রেন থেকে সেটা দেখব তা নয়, যদি আলোর পাশাপাশি সেকেন্ডে এক লক্ষ মাইল বেগে ছুটে যাওয়া একটা রকেট থেকে দেখি সেখানেও তাই দেখব। সেই আলোর বেগ আমাদের প্রচলিত নিয়মে (1,86,000-1,00,000=86,000) ছিয়াশি হাজার মাইল হবে হবে না, এবারেও হবে এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল। ধরা যাক আমরা প্রায় আলোর বেগের কাছাকাছি বেগে একটা মহাকাশযানে যাচ্ছি, যার গতিবেগ একলক্ষ পঁচাশি হাজার নয়শত নিরানব্বই মাইল, অর্থাৎ আলো থেকে তার গতিবেগ মাত্র এক মাইল কম। তাহলেও আমাদের মহাকাশযান থেকে মনে হবে আলোটি তার নিজস্ব গতিবেগ সেকেন্ডে এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল বেগে ছুটছে! (খুব স্বাভাবিক প্রশ্ন, আমাদের মহাকাশযানটি যদি আলোর বেগে ছুটে তাহলে কী হবে? আইনস্টাইনের এই সূত্র দুটি থেকেই বের করে ফেলা যায় কোন বস্তুর গতিবেগই ঠিক আলোর গতিবেগের সমান হতে পারবে না। কখনো না!)