আমি জানি কেউ কেউ নিশ্চয়ই আমার এই কথায় সন্দেহ পোষণ করছে, আমাদের চোখ যখন এই বিচিত্র বিষয়টি দেখতে পারবে না তাহলে শুধু শুধু এই বিয়ষটা উত্থাপন করে মানুষকে বিভ্রান্ত করার কী যুক্তি রয়েছে? সন্দেহপ্রবণ পাঠকদের আশ্বস্ত করার জন্যে বলা যায় যে, খুব কম আলো দেখার জন্যে বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি আছে তাদের একটার নাম হচ্ছে ফটো মালটিপ্লায়ার টিউব। মানুষের চোখ যখন কিছুই দেখতে পায় না এই ফটো মাল্টিপ্লায়ার টিউব সেখানেও দেখতে পায়। এই ফটো মাল্টিপ্লায়ার টিউব দিয়ে বিজ্ঞানীরা সন্দেহাতীতভাবে দেখেছেন যে কম আলো আসলে কমসংখ্যক আলোর ঝলকানি। পানির যেরকম ফোঁটা আছে আলোরও সেরকম ফোঁটা আছে, সেই ফোঁটাকে অনেকটা কাকতালীয়ভাবে বলা হয় ফোটন! যখন তীব্র আলো থাকে তখন আলোর এই কণা বা ফোটনকে আলাদাভাবে বোঝা যায় না, কিন্তু যখন আলো খুব কমে আসে তখন সেটাকে অস্বীকার করার কোনো উপায়ই নেই।
এবারে আমি সব পাঠকদের বিপদের মাঝে ফেলে দিতে পারি। প্রথম পরীক্ষাটা আমাদের কল্পনা করে নিতে হয়েছে, চোখ আরেকটু বেশি সংবেদী হলে আমাদের কল্পনা। করতে হতো না আমরা সত্যি সত্যি দেখতে পেতাম। দ্বিতীয় পরীক্ষাটি আমরা সহজেই করতে পারি, আসলে সবাই কখনো না কখনো করেও ফেলেছি। সেটা হচ্ছে জানালার কাচ দিয়ে জোছনা দেখা। আমরা সবাই নিশ্চয়ই কখনো না কখনো রাত্রিবেলা ঘুমানোর সময় ঘরের আলো নিভিয়ে আবিষ্কার করেছি বাইরে কী সুন্দর জোছনা! শুধু যে জোছনা তাই নয়, জানালার কাচ দিয়ে সেই জোছনা ঘরের ভেতরে এসে আমাদের মুগ্ধ করেছে। যতক্ষণ ঘরে আলো জ্বলছে ততক্ষণ কিন্তু আমরা বাইরের জোছনাটুকু দেখতে পাই না। তার কারণটা খুব সহজ, জানালার কাঁচকে আমরা স্বচ্ছ বলে ভাবি কিন্তু সেটা পুরাপুরি স্বচ্ছ নয়, তার পৃষ্ঠ থেকে অল্প একটু (নিখুঁত হিসেবে চার শতাংশ) আলো প্রতিফলিত হয়। তাই যখন ঘরের ভেতরে তীব্র আলো জ্বলছে তার শতকরা চার শতাংশ জানালার কাচ থেকে প্রতিফলিত হয়ে ভেতরে আসছে। এই চার শতাংশ আলো জোছনার কোমল আলো থেকে তীব্র, তাই আমরা সেটাকেই দেখি, জোছনার আলোকে আর দেখি না!
এবারে আবার বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় আসি–আমরা জোছনা দেখতে গিয়েই আবিষ্কার করেছি আলোর চার শতাংশ প্রতিফলিত হয়। এবারে সেই একই পরীক্ষাটি করতে চাই, শুধু পরীক্ষাটি করা হবে কম আলোতে। অর্থাৎ, যখন আলো আসলে রশ্মি নয় যখন আলো হচ্ছে ফোঁটা বা কণা, বৈজ্ঞানিক ভাষার আলোর ফোটন! তখন আমরা কী দেখব?
বৈজ্ঞানিকরা অসংখ্যবার এই পরীক্ষা করেছেন এবং তারা দেখেছেন আলো যখন কমে আসে তখনও চার শতাংশ প্রতিফলিত হয়। অর্থাৎ, যদি একশটা ফোটন কাচের পৃষ্ঠকে আঘাত করে তখন ছিয়ানব্বইটা বের হয়ে যায় কিন্তু চারটা প্রতিফলিত হয়। এখন লক্ষ টাকার প্রশ্ন : কোন চারটা প্রতিফলিত হবে? তার উত্তর হচ্ছে : কেউ জানে না! একশটা ফোটন কাচের পৃষ্টকে আঘাত করলে মোটামুটিভাবে চারটা প্রতিফলিত হবে সেটা বিজ্ঞানীরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারেন কিন্তু কোন চারটা সেটা তারা কখনোই আগে থেকে বলতে পারেন না। কেউ যেন মনে না করে ভালো যন্ত্রপাতি হলে এটা বলে দেয়া যাবে, এর সাথে যন্ত্রপাতির কোনো সম্পর্ক নেই, বিজ্ঞানীরা কখনোই এটা বলতে পারবে না। প্রকৃতি সেই তথ্যটা আমাদের থেকে আড়াল করে রেখেছে। বিজ্ঞানের সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা থেকে হঠাৎ আমাদের সরে আসতে হচ্ছে সম্ভাবনার জগতে! একটা-কিছু হবে না বলে আমাদের বলতে হচ্ছে “হতে পারে” এবং “হবে” থেকে “হতে পারে এই বিষয়টিই হচ্ছে কোয়ান্টাম মেকানিক্স।
আমাদের জীবনে সম্ভাবনার বিষয়টা আমরা এর মাঝে অনেকবার দেখেছি। লুডু খেলার। সময় যখন ছক্কাটি ফেলি আমরা আগে থেকে কখনই সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারি না কত বের হতে। কিন্তু সব সময়েই মোটামুটি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি ছয়বারের মাঝে একবার ছয় পড়তে পারে। ছয় পড়ার প্রোবাবিলিটি বা সম্ভাবনা হচ্ছে ছয়ভাগের এক ভাগ। নিশ্চিত করে কিছু একটা বলতে না পারা, শুধুমাত্র একটা বিষয়ের সম্ভাবনাটুকু জানতে পারাকে অনেকেই বিজ্ঞানের একটা বড় দুর্বলতা বলে মনে করতে পারেন, কিন্তু সেটা মোটেও তা নয়। প্রকৃতি তার রহস্যের পুরোটুকু বিজ্ঞানীদের কাছে প্রকাশ করতে রাজি নয়। বিজ্ঞানীরা সেটি বুঝে ওঠার পর সেটাকে গ্রহণ করেই এগিয়ে গেছেন। কোয়ান্টাম মেকানিক্স ব্যবহার করে তারা কিন্তু প্রকৃতির রহস্য উদঘাটন করেই গেছেন, নিউক্লিয়ার বোমা থেকে সিডি প্লেয়ার কোথাও কোন সমস্যা হয় নি!
একজন সাধারণ মানুষ যেটুকু গণিত জানে সেটা দিয়েই কিন্তু কোয়ান্টাম মেকানিক্সের একেবারে ভেতরে যাওয়া সম্ভব, কেমন করে তার নিখুঁত হিসেব নিকেশ করা হয় সেটাও দেখানো সম্ভব। কিন্তু এই ছোট লেখায় তার ভেতরে না গিয়ে আমরা কোয়ান্টাম মেকানিক্সের একটা চমকপ্রদ তথ্য দিয়ে শেষ করে দিই। বিষয়টি এত চমকপ্রদ যে, সেটি এর মাঝে সাধারণ মানুষের কথাবার্তায় চলে এসেছে এবং সেটি হচ্ছে অনিশ্চয়তার সূত্র বা আনসার্টেইনিটি প্রিন্সিপাল।
‘অনিশ্চয়তার সূত্র’ নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে কোনো কিছু যে নিশ্চিতভাবে জানা যাবে না এটা তার একটা ইঙ্গিত দিচ্ছে। অনেকভাবেই ‘অনিশ্চয়তার সূত্র’ ব্যাখ্যা করা যায় তবে বুঝতে সোজা হয় যদি আমরা সেটা অবস্থান আর ভরবেগ দিয়ে ব্যাখ্যা করি। খুব স্কুলভাবে বলা যায় আমরা কোনো বস্তুর অবস্থান আর গতিবেগ কখনোই পুরোপুরি জানতে পারব না। অন্যভাবে বলা যায় যদি অবস্থান নিশ্চিতভাবে জেনে ফেলি তাহলে গতিবেগ কত সেটা সম্পর্কে কোনো ধারণাই থাকবে না। আবার এর উল্টোটাও সত্যি অর্থাৎ গতিবেগটা যদি নিশ্চিতভাবে জেনে যাই তাহলে এর অবস্থান সম্পর্কে কিছুই জানতে পারব না। আমাদের খুব সৌভাগ্য যে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অনিশ্চয়তার সূত্র কার্যকরী নয়, তাহলে যে কী ভয়ানক বিপদে পড়তাম সেটি আর বলার মতো নয়।