অটিজম এর বিভিন্ন স্তর রয়েছে, অনেক ক্ষেত্রেই সেটা খুব মৃদু। কাজেই সেই অটিস্টিক শিশুটি হয়তো কষ্ট করে সমাজে টিকে থাকতে পারে। তার ভেতরকার যন্ত্রণার খবর কেউ কোনোদিন জানতে পারে না। অনেক ক্ষেত্রে অটিজম এত তীব্র যে, সেই শিশুটির পক্ষে স্বাভাবিক জীবন প্রায় অসম্ভব, সারাটি জীবন অন্যের সাহায্যের উপর তার নির্ভর করতে হয়। পৃথিবীতে এত বেশি অটিস্টিক শিশু রয়েছে যে, মোটামুটি নিশ্চিতভাবে বলা যায় আমরা সবাই কখনো না কখনো হয়তো এক-দুজন অটিস্টিক শিশু দেখেছি কিন্তু সেটা বুঝতে পারি নি। অটিস্টিক শিশুদের চালচলনে কিছু বৈশিষ্ট্য দেখা যায়, যেমন তারা চোখাচোখি তাকাতে পছন্দ করে না, ক্রমাগত হাত নাড়ানো বা মাথা নাড়ানো এ ধরনের একটানা কোনো একটা কাজ করে যেতে থাকে। ছোট বাচ্চারা যে-রকম হইচই করে একসাথে খেলাধুলা করে অনেক সময়ই তারা এটা করতে চায় না, নিজের ভেতরে গুটিয়ে থাকে। একেবারে সহজ কাজটিও তাদের হাতে ধরে করিয়ে দিতে হয়। রুটিনবাঁধা জীবনে তারা অভ্যস্ত হয়ে যায় এবং সেই রুটিনের একটু উনিশ-বিশ হলেই তারা খুব বিচলিত হয়ে পড়ে। একটা ছোট অটিস্টিক শিশুকে দেখা যাবে সে একই ধরনের খেলনা ঠিক একইভাবে সাজিয়ে রাখছে এবং কেউ যদি সেটা একটুও পরিবর্তন করে তাহলে সে সেটা সহ্য করতে পারে না। কেউ কেউ ছোটখাট শব্দও সহ্য করতে পারে না, দুই হাতে কান চেপে ধরে রাখে। অনেক অটিস্টিক শিশু কথা বলতে পারে না, কেউ কেউ কথা বললেও সেটা হয় এক ধরনের সীমাবদ্ধ কথা। অনেক সময়েই দেখা যায় একটা শিশু একেবারে স্বাভাবিকভাবে বড় হতে হতে হঠাৎ করে অটিস্টিক হতে শুরু করেছে। সাধারণত তিন বছর বয়সের দিকে এই পরিবর্তনটি শুরু হয় এবং আর আগের অবস্থায় ফিরে আসে না। ঠিক কী কারণ কেউ জানে না একটি মেয়ের থেকে একটি ছেলের অটিস্টিক হবার সম্ভাবনা প্রায় চার গুণ বেশি।
অটিজম কেন হয়, কীভাবে হয় বিজ্ঞানীরা এখনো বের করতে পারেন নি। সাধারণভাবে অনুমান করা হয় এর পেছনে একটা নির্দিষ্ট কোনো কারণ নেই, অনেকগুলো কারণ। খুব হালকাভাবে অটিস্টিক (যাকে হয়তো অমিশুক বা দুরন্ত শিশু হিসেবে ধরে নেয়া হয়) থেকে গুরুতর অটিস্টিক (যেখানে শিশুটি কিছুই করতে পারে না, একেবারে পুরাপুরি অচল) শিশু রয়েছে বলে আজকাল এ.এস.ডি. (অটিস্টিক স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার) শব্দটি ব্যবহার করা হয়, বোঝানো হয় এটি একেবারে নির্দিষ্ট এক ধরনের সমস্যা নয় এর ব্যাপ্তি বিশাল।
অন্যান্য মানসিক বা মস্তিষ্কের সমস্যা থেকে অটিজমকে একটু আলাদা করে দেখা হয় তার একটা কারণ আছে। আনুমানিক একশ জন অটিস্টিক শিশুর ভেতরে এক দুজন শিশু বের হয়ে যায় যাদের এক ধরনের অসাধারণ ক্ষমতা থাকে। আমি একটি অটিস্টিক কিশোরকে দেখেছি তাকে যে কোনো তারিখ বলা হলে সেটি কী বার সে বলে দিতে পারে। শত শত বছরের হাজার হাজার দিনের ভেতর কোনটি কী বার সেটি একজন সাধারণ মানুষ কিন্তু কিছুতেই বলতে পারবে না। খুব সুন্দর ছবি আঁকতে পারে সেরকম অটিস্টিক শিশু রয়েছে। সঙ্গীতে অসাধারণ প্রতিভা এ-রকম অটিস্টিক শিশু রয়েছে। একবার শুনেই সুরটুকু পিয়ানোতে তুলে ফেলতে পারে এ-রকম অজস্র উদাহরণ। রয়েছে। এই ধরনের অটিস্টিক শিশুদের বলা হয় স্যাভান্ট (Savant)। রেইনম্যান নামে একটা ছায়াছবিতে ডাস্টিন হফম্যান এ-রকম একজন স্যাভান্টের অভিনয় করে বিখ্যাত হয়েছিলেন।
যে শিশু, কিশোর বা মানুষটিকে আপাতঃদৃষ্টিতে বুদ্ধিহীন বা বোধশক্তিহীন বলে মনে হয় কিন্তু তার ভেতরে অসম্ভব ক্ষমতাশালী একটা মস্তিষ্ক লুকিয়ে আছে সেটি পৃথিবীর বিজ্ঞানীদের খুব কৌতূহলী করে তুলেছে, তারা দীর্ঘদিন থেকে বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করছেন। টাইম ম্যাগাজিনে 2006 সালের মে মাসে একটি অটিস্টিক কিশোরীর কথা ছাপা হয়েছে। কিশোরীটি কোনো কিছু শিখতে অক্ষম, লেখাপড়া দূরে থাকুক কথা পর্যন্ত বলতে পারে না। বাবা-মা অনেক চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়ে এই মেয়েটির জন্যে একটি অক্ষম অর্থহীন কঠিন জীবনের জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। মেয়েটির চিকিৎসক একদিন কৌতূহলবশত তাকে একটি বিশেষ ধরনের কম্পিউটারের কী বোর্ড ধরিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কি কিছু বলতে চাও?” অনভ্যস্ত হাতে মেয়েটি কী বোর্ড চাপ দিয়ে লিখল, “মা, আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি!” সবাই একেবারে হতবাক হয়ে গেলেন, কেউ ভুলেও ধারণা করে নি মেয়েটি কোনো ভাষা জানে! যখন বোঝা গেল এই বিশেষ কী বোর্ড দিয়ে সে বাইরের পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ করতে পারে তখন তার জন্যে একটি নূতন জগৎ উন্মুক্ত হয়ে গেল। কিছুদিনের ভেতর জানা গেল কিশোরী মেয়েটির রয়েছে ভাষার উপর অসম্ভব দক্ষতা, চমৎকার তার রসবোধ। দেখতে-দেখতে সে কলেজের এলজেবরা আর জীববিজ্ঞান পড়তে শুরু করল। এই মেয়েটির মস্তিষ্ক একজন মেধাবী মানুষের মস্তিষ্ক, শুধুমাত্র শুনে-শুনে সে অনেক কিছু শিখেছে কিন্তু কীভাবে অন্যের সাথে যোগাযোগ করতে হয় জানে না বলে কেউ সেই খোঁজ পায় নি। বিজ্ঞানীদের কাছে এখনো বিষয়টা একটা রহস্যের মতো। সৃষ্টি জগতের সবচেয়ে জটিল জিনিস হচ্ছে মানুষের মস্তিষ্ক, সেই মস্তিষ্কের রহস্যের মাঝেই লুকিয়ে আছে অটিজমের প্রশ্নের উত্তর।