সবচেয়ে ছোট তরঙ্গ দৈর্ঘ্য বেগুনি এবং সবচেয়ে বড় তরঙ্গ দৈর্ঘ্য লালের ঠিক মাঝখানে হচ্ছে সবুজ। মানুষের চোখ সবচেয়ে বেশি সংবেদশীল হচ্ছে সবুজ রঙে (15.3 নং ছবি)। এজন্যেই সম্ভবত পৃথিবীর সবুজ গাছ দেখতে আমাদের এত ভালো লাগে! তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের সাথে মিল রেখে রঙগুলো যদি সাজাই সেগুলো হচ্ছে বেগুনি নীল সবুজ হলুদ কমলা এবং লাল। সূর্যের আলোতে এইসব রঙগুলোই আছে এবং যখন সব রঙগুলো মিশে থাকে আমরা আলাদাভাবে কোনো রঙই দেখতে পাই না। আলোটাকে বর্ণহীন বা সাদা আলো বলে মনে হয়।
এখন আমরা মোটামুটি অনুমান করতে পারব কেন আমরা নানা রঙ দেখতে পাই। একটা ফুলকে যদি লাল মনে হয় তাহলে বুঝতে হবে সেই ফুলটা লাল রঙ ছাড়া অন্য সব রঙ শোষণ করে নিচ্ছে। ফুল থেকে শুধুমাত্র লাল রঙটি বিচ্ছুরিত হয়ে আমাদের চোখে আসছে। গাছের পাতাকে সবুজ (15.4 নং ছবি) মনে হওয়ার কারণ হচ্ছে পাতাটি সবুজ রঙ ছাড়া অন্য সব রঙ শোষণ করে নিচ্ছে। শুধুমাত্র সবুজ রঙটি গাছের পাতা থেকে আমাদের চোখে আসছে বলে সেটাকে মনে হচ্ছে সবুজ! যদি কোনো কারণে সবগুলো রঙই শোষণ করে নেয় তাহলে সেটাকে আমরা বলি কালো। যদি কোনো রঙই শোষণ করতে না পারে তাহলে সেটা হচ্ছে সাদা।
এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে পৃথিবীতে রঙের কোনো অভাব নেই। আমরা বেগুনি নীল সবুজ হলুদ কমলা এবং লাল এই ছয়টি রঙের নাম বলেছি, এর কোনোটিই হঠাৎ করে শেষ হয়ে পরেরটা শুরু হয় না খুব ধীরে ধীরে একটি আরেকটির সাথে মিশে যায়। রঙগুলো আলাদাভাবে দেখা একসময় খুব কঠিন ছিল। নিউটন প্রিজম ব্যবহার করে রঙগুলো আলাদা করে সারা পৃথিবীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। এখন আমাদের সবার কাছেই রয়েছে গান কিংবা কম্পিউটারের সিডি। তার মাঝে সূর্যের আলো ফেলে সেটাকে সাদা দেয়ালে প্রতিফলিত করলেই আমরা আসলে এই রঙগুলো দেখতে পাব। যারা কখনো দেখে নি তারা একবার যেন দেখে নেয়, প্রকৃতি কত রঙিন শুধু তাহলেই সেটা অনুভব করা যাবে!
কাজেই আমাদের মনে হতে পারে দৃশ্যমান এই রঙগুলো তৈরি করা নিশ্চয়ই খুব কঠিন। টেলিভিশন কিংবা কম্পিউটারের মনিটরে আমরা এমন কোনো রঙ নেই যেটা দেখতে পাই না। সম্ভাব্য সবগুলো রঙ পেতে না জানি কতগুলো রঙ ব্যবহার করতে হয়। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে এইসব রঙ তৈরি করতে আসলে শুধুমাত্র তিনটি রঙ ব্যবহার করা হয়। সেগুলো হচ্ছে লাল, সবুজ এবং নীল। যারা আমার কথা বিশ্বাস করে না তাহলে টেলিভিশন কিংবা কম্পিউটারের মনিটরের উপর সাবধানে এক ফোঁটা পানি দিয়ে দেখতে পার। পানির ফোঁটাটা একটা ম্যাগনিফাইং গ্লাস হিসেবে কাজ করবে এবং সেখানে পরিষ্কার দেখা যাবে তিনটি রঙ। কোন রঙ মিশে কোন রঙ তৈরি হয় সেটা 15.5 নং ছবিতে দেখানো হয়েছে। ছবিটা বোঝার জন্যে কল্পনা করে নেয়া যায় যে সাদা দেয়ালে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন আলোর টর্চ লাইট এমনভাবে ফেলা হয়েছে যেন সেগুলো একটা আরেকটার উপর পরে। এখানে লাল নীল আর সবুজ হচ্ছে প্রাইমারি রঙ। সেগুলো মিলে যে রঙ হয়েছে সেগুলো হচ্ছে সেকন্ডারি রঙ। যে জিনিসটা উল্লেখযোগ্য সেটা হচ্ছে তিনটি রঙই যখন সমানভাবে মিশে যায় তখন তৈরি হয় সাদা রঙ। রঙ মিশিয়ে এভাবে নূতন রঙ তৈরি করার পদ্ধতিটার নাম রঙের যোগ জাতীয় মিশ্রণ। এখানে একটা রঙের সাথে আরেকটা রঙ যোগ করা হয়।
কেউ কেউ নিশ্চয়ই রঙের এই মিশ্রণ প্রক্রিয়াটি পরীক্ষা করার জন্যে তাদের জল রংয়ের বাক্স নিয়ে রঙ মিশিয়ে পরীক্ষা করতে চাইবে। তারা লাল এবং সবুজ রঙ মিশিয়ে নিলে অবাক হয়ে আবিষ্কার করবে যে সেটা মোটেও হলুদ না হয়ে কেমন জানি কালচে হয়ে গেছে। তার কারণ এভাবে রঙ মেশানো হলে সেটা যোগ জাতীয় মিশ্রণ হয় না সেটা হয়ে যায় বিয়োগ জাতীয় মিশ্রণ। তার কারণ জল রংয়ের ছোট ছোটকণাগুলো তখন পাশাপাশি থাকে না। তারা থাকে একটার উপর আরেকটা। সে কারণে তখন একটা রঙকে দেখতে হয় অন্য আরেকটা রঙের ভেতর দিয়ে অনেকটা রঙের ফিল্টারের মতো। প্রত্যেকটা ফিল্টার তখন তার নিজস্ব রঙ ছাড়া অন্য সব রঙ শোষণ করে নেয়। রঙের এই বিয়োগ জাতীয় মিশ্রণ দিয়ে কোন কোন প্রাইমারি রঙ দিয়ে কোন কোন সেকেন্ডারি রঙ তৈরি করা হয় সেগুলো 15.6 নং ছবিতে দেখানো হয়েছে।
যারা ছাপা ছাপির কাজের সাথে যুক্ত তারা হয়তো জিজ্ঞেস করতে পারেন, যদি তিনটি রং দিয়েই সব রঙ তৈরি করা যায় তাহলে রঙিন ছবিকে ফোর কালার বা চার রঙা ছবি বলে কেন? কারণটি আর কিছুই না, রঙকে আরো ঝকঝকে বা স্পষ্ট করার জন্যে আলাদা করে কালো রঙটি ব্যবহার করা হয়।
মজার ব্যাপার হচ্ছে কালো কিন্তু রঙ নয়। কালো হচ্ছে রঙের অভাব! যখন কোনো রঙ থাকে না সেটাই হচ্ছে কালো–সেটা কী আমাদের সব সময় মনে থাকে?
.
16. অটিজম
কম্পিউটার নিয়ে কাজ করার সময় হঠাৎ করে মনিটরটি যদি নষ্ট হয়ে যায় তখন কী হবে? কী-বোর্ড এবং মাউস কাজ করছে বলে কম্পিউটারকে নির্দেশ দেয়া যাবে, তথ্য পাঠানো যাবে। সি.পি.ইউ.টি সবল রয়েছে বলে সেই নির্দেশ এবং তথ্য অনুযায়ী কম্পিউটার তার কাজও করতে থাকবে কিন্তু মনিটরটি নষ্ট থাকার কারণে আমরা তার কিছুই জানতে পারব না। কম্পিউটারটা কাজ করছে কিন্তু তার সাথে যোগাযোগ করতে পারছি না, আমরা নিশ্চয়ই হতাশায় ছটফট করতে থাকব। এই হতাশা নিশ্চয়ই লক্ষগুণ বেড়ে যাবে যদি বিষয়টা একটা কম্পিউটারকে নিয়ে না হয়ে একটা মানুষকে নিয়ে হতো। আমরা যদি কখনো দেখি একজন মানুষ, আপাতঃদৃষ্টিতে তাকে বুদ্ধিমান মনে হচ্ছে–সে শুনতে পায়, দেখতে পায়, তার স্পর্শের অনুভূতি আছে, তার কথা বলার ক্ষমতা আছে কিন্তু কথা বলতে চায় না, কারো চোখের দিকে তাকায় না, নিজের ভেতরে একটা রহস্যময় জগতে আটকা পড়ে আছে শত চেষ্টা করেও তার মনের খোঁজ পাওয়া যায় না তাহলে তার চারপাশের মানুষের ভেতরে কী ধরনের হতাশার জন্ম নেবে সেটা কি আর ব্যাখ্যা করতে হবে? সারা পৃথিবীতেই এ ধরনের একটা রহস্যময় অবস্থার মানুষের খোঁজ পাওয়া গেছে, এই মানুষগুলোকে বলে অটিস্টিক (Autistic) এবং অবস্থাটির নাম অটিজম (Autism)। 1970 সালে হার্ভাডের শিশু হাসপাতালে যখন প্রথম একটি অটিস্টিক শিশুকে ভর্তি করা হয় তখন হাসপাতালের প্রধান সব ডাক্তারদের এই বলে ডেকে পাঠিয়েছিলেন, “তোমরা সবাই এই রহস্যময় শিশুটিকে দেখে যাও, কারণ ভবিষ্যতে আর কখনো এ-রকম একজনকে দেখার সুযোগ পাবে না।” সেই বিখ্যাত শিশু হাসপাতালের প্রধান নিশ্চয়ই কল্পনাও করেন নি যে, তিন দশকের মাঝে সেই দেশে পরিসংখ্যান নিয়ে দেখা যাবে প্রতি 166 টি শিশুর মাঝে একটি শিশু অটিস্টিক। দরিদ্র বা স্বল্পোন্নত দেশে এ-রকম পরিসংখ্যান নেয়ার সুযোগ হয় না। যদি হতো তাহলে সংখ্যাটি এরকমই হতো বলে বিশেষজ্ঞেদের ধারণা। বর্তমান পৃথিবীতে এ-রকম বিপুল সংখ্যক অটিস্টিক শিশুর একটা বিস্ফোরণ কেন ঘটছে কেউ এর উত্তর জানে না।