.
15. চোখ আলো ও রঙ
আমি যখন পিএইচ. ডি. করছি তখন একদিন ল্যাবরেটরিতে আমার প্রফেসর এসে হাজির, কনুইয়ের কাছে কোথায় জানি কেটে গেছে, হাত রক্তে মাখামাখি। আমাকে তার হাতটা দেখিয়ে বলল, এই দেখো, এটা রক্ত! আমি চোখ কপালে তুলে বললাম, অবশ্যই রক্ত! আমার প্রফেসর নিশ্বাস ফেলে বলল, আমি ভেবেছিলাম গ্রীজ! আমি তো কালার ব্লাইন্ড, রং দেখতে পাই না!’
আমার প্রফেসর কালার ব্লাইড ছিলেন, (শব্দটার যথার্থ বাংলা প্রতিশব্দ আমার জানা নেই। আমি কোথাও কোথাও এটাকে রং অচেতন হিসেবে বলেছি, রঙ্গান্ধ থেকে রঙ অচেতন নিশ্চয়ই ভালো শোনায়!) যারা পুরাপুরি কালার ব্লাইন্ড, কোনো রঙই দেখতে পান না তাদের জন্যে সবারই নিশ্চয়ই এক ধরনের মায়া হয়। পৃথিবীর এত সৌন্দর্য তারা পুরাপুরি উপভোগ করতে পারেন না। যিনি রঙ দেখেন না তিনি পৃথিবীর পুরো সৌন্দর্য কীভাবে দেখবেন। কিন্তু রঙটা কী? আমরা কেমন করে দেখি? সেটা নিয়ে নিশ্চয়ই আমাদের ভেতরে এক ধরনের কৌতূহল রয়েছে।
দেখা শব্দটার অর্থ চোখের ভেতরে আলো প্রবেশ করা, চোখের রেটিনাতে সেই আলোটা এক ধরনের অনুভূতির জন্ম দেয় যেটা অপটিক নার্ভ দিয়ে আমাদের মস্তিষ্কে পৌঁছায়। মস্তি ষ্কের যে অংশটা দেখার কাজে ব্যবহার হয় সেটা আমাদের মাথার পিছন দিকে। একবার আমার এক ছাত্র দুর্ঘটনার মাথায় আঘাত পেয়ে মৃত্যুর সাথে প্রায় এক মাস যুদ্ধ করে শেষ পর্যন্ত মারা গিয়েছিল। এই দীর্ঘ সময়ে সে জ্ঞান ফিরে পায় নি, ডাক্তার বলেছিলেন, জ্ঞান ফিরে পেলেও দৃষ্টিশক্তি সম্ভবত ফিরে পাবে না। মস্তিষ্কের যে অংশটুকু দেখার কাজে ব্যবহার হয় তার সেই জায়গাটুকু সবচেয়ে বেশি আঘাত পেয়েছিল।
আমাদের চোখের ভেতর এক ধরনের লেন্স রয়েছে, কোনো কিছু থেকে আলো সেই লেন্সে পড়লে সেটা রেটিনাতে সেই জিনিসটার উল্টো প্রতিবিম্ব তৈরি করে (15.1নং ছবি)। আমরা কোনো কিছুকে উল্টো দেখি না কারণ দেখা নামের পুরো প্রক্রিয়াটা ঘটে মস্তিষ্কে। মস্তিষ্ক সেগুলো সামলে নেয়। চোখের মাঝে আলো এসে পড়া, অপটিক নার্ভ দিয়ে সেই অনভূতি মস্তিষ্কে গিয়ে পৌঁছানো মানেই কিন্তু দেখা নয়, এর মাঝে শেখারও একটা ব্যাপার আছে। নূতন জন্ম হয়েছে সে-রকম শিশুদের দেখলে সেটা বোঝা যায়, তারা ‘তাকায়’ কিন্তু তখনো দেখাটা শিখে উঠে নি তাই চোখের দৃষ্টিতে এক ধরনের শূন্যতা দেখা যায়। একটা শিশুর জন্মের পর যদি তার চোখ দুটো কালো কাপড় দিয়ে দীর্ঘদিনের জন্যে ঢেকে দেয়া হয় তাহলে একটা ভয়ংকর ব্যাপার ঘটবে। তার মস্তিষ্কের যে অংশটুকু দেখার কাজে ব্যবহার হয় সেখানে কোনো সংকেত না এলে মস্তিষ্ক সেই অংশটুকু অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করতে শুরু করে দেবে। যদি পরে চোখের কালো কাপড়টুকু খুলে দেয়া হয়, তাহলে চোখ থেকে অপটিক নার্ভ হয়ে অনুভূতিটুকু মস্তিষ্কে পৌঁছাতে শুরু করবে কিন্তু কোনো লাভ হবে না। মস্তিষ্কের যে অংশটুকুর দেখার কাজে ব্যবহার হবার কথা ছিল মস্তিষ্ক সেটা অন্য কাজে ব্যবহার করে ফেলেছে, কাজেই সে আর কোনোদিন দেখতে পাবে না। বিজ্ঞানীরা এই ধরনের নিষ্ঠুর পরীক্ষা করে এটা বের করেন নি, কোনো কোনো শিশু চোখের সমস্যা নিয়ে জন্মায়। সেই সমস্যাটি ধরা পড়তে এবং দূর করতে যদি কয়েক বছর সময় লেগে যায়। তাহলে দেখা যায় বাচ্চাটি আর দেখতে পারছে না।
আমাদের দেখার জন্যে চোখের ভেতর আলো এসে পড়তে হয়। আলো হচ্ছে বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গ, এবং তরঙ্গ হলেই তার একটা তরঙ্গ দৈর্ঘ্য থাকে। তরঙ্গ দৈর্ঘ্য যদি মিটার খানেক লম্বা হয় তাহলে সেটাকে বলে রেডিও ওয়েভ, যদি হয় কয়েক এস্ট্রম (এক মিটারের দশ কোটি ভাগের এক ভাগ) তাহলে সেটাকে বলে এক্সরে। বলাই বাহুল্য সেগুলো আমরা চোখে দেখতে পাই না। সত্যি কথা বলতে কী বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গের খুব ক্ষুদ্র একটা অংশ দেখতে পাই সেটা হচ্ছে 0.4 মাইক্রন (এক মিটারের এক মিলিওন ভাগের এক ভাগ) থেকে 0.7 মাইক্রন (15.2নং ছবি)। এর বাইরে কিছুই আমরা দেখতে পাই না। প্রকৃতি ঠিক কী কারণে এই ছোট্ট একটা অংশের জন্যে আমাদের চোখকে সংবেদনশীল করে রেখেছে এবং এর বাইরের কোনো কিছু আমরা দেখতে পাই না সেটা একটা রহস্যের মতো মনে হতে পারে। আসলে ব্যাপারটা একেবারেই রহস্যময় নয়। সূর্যের আলোর শুধুমাত্র এই অংশটুকুই সবচেয়ে ভালোভাবে পৃথিবী পৃষ্ঠে আসতে পারে, বাকি অংশটুকু বাতাসের জলীয় বাষ্পে শোষিত হয়ে যায়। এই শোষণটুকু ছোটখাট শোষণ নয়–প্রায় লক্ষগুণ শোষণ। কাজেই আমাদের চোখ যদি আলোর এই তরঙ্গ দৈর্ঘ্যে সংবেদনশীল না হয়ে অন্য অংশে সংবেদশীল হতো তাহলে সবচেয়ে রৌদ্রোজ্জ্বল দিনেও পৃথিবীটাকে মনে হতো ঘুটঘুটে অন্ধকার!
আলোর এই তরঙ্গ দৈর্ঘ্যই আসলে হচ্ছে রঙ। সবচেয়ে ছোট তরঙ্গ দৈর্ঘ্য বেগুনি এবং সবচেয়ে বড় তরঙ্গ দৈর্ঘ্য হচ্ছে লাল। বেগুনির তরঙ্গ দৈর্ঘ্য থেকেও ছোট হলে আমরা সেটাকে বলি অতিবেগুনী আলট্রাভায়োলেট এবং লাল থেকে বড় হলে আমরা সেটাকে বলি অবলাল বা ইনফ্রারেড। অতিবেগুনী রশ্মি জীবাণু মুক্ত করার জন্যে ব্যবহার করা হয়, অবলাল রশ্মি ফাইবার অপটিক্স কমিউনিকেশান্সে ব্যবহার হয়। বলার অপেক্ষা রাখে না যে এর কোনোটাই আমরা চোখে দেখি না।