বিজ্ঞানীদের এই এক্সপেরিমেন্ট দেখে উৎসাহিত হয়ে স্ট্যানলি মিলগ্রাম নামে একজন মনোবিজ্ঞানী প্রায় এ ধরনের একটি এক্সপেরিমেন্ট করার উদ্যোগ নিলেন–তারা মানবিক অনুভূতিটি খোঁজার চেষ্টা করলেন মানুষের ভেতর! তাদের এক্সপেরিমেন্টেও একজন অন্যকে ইলেকট্রিক শক দেবে তবে দুজনেই হবে মানুষ–একজন মানুষ অন্য মানুষকে ইলেকট্রিক শক দেবে! একটা খাঁচার ভেতরে একটা মানুষকে আটকে রাখা হলো, বাইরে একটা সুইচ। সেই সুইচটা টিপে ধরলেই ভেতরের হতভাগা মানুষটা একটা ভয়াবহ ইলেকট্রিক শক খাবে–যন্ত্রণায় বিকট স্বরে চিৎকার করবে মানুষটি।
এক্সপেরিমেন্ট করার জন্যে প্রথমে একটা মানুষকে বেছে নেয়া হয় যার মানবিক অনুভূতি পরীক্ষা করা হবে। তাকে বলা হয় তাকে নির্দেশ দিলে সে যেন সুইচ টিপে ধরে। তখন ল্যাব কোর্ট পরা গুরুগম্ভীর একজন বিজ্ঞানী আসেন, এসে মানুষটিকে আদেশ দেন সুইচ টিপে ধরতে, মানুষটি তখন সুইচ টিপে ধরে আর ভয়াবহ ইলেকট্রিক শক খেয়ে খাঁচার ভেতরের মানুষটা বিকট চিৎকার করতে থাকে!
আমি নিশ্চিত সবাই একমত হবেন যে, এই ধরনের একটা এক্সপেরিমেন্ট দাঁড় করানোই একটা ভয়ংকর অমানবিক ব্যাপার। তবে আসলে বিষয়টা অন্যরকম। যে মানুষটির মানবিক অনুভূতি পরীক্ষা করা হচ্ছে যে জানে না খাঁচার ভেতরের মানুষটি একজন চৌকস অভিনেতা, তাকে মোটেও ইলেকট্রিক শক দেয়া হচ্ছে না–সে ইলেকট্রিক শক খেয়ে যন্ত্রণার বিকট চিৎকার করার অভিনয় করছে। তার চেয়ে বড় কথা এই এক্সপেরিমেন্টটি মানুষের মানবিক অনুভূতি যাচাই করার জন্যে দাঁড়া করা হয় নি, এটি দাঁড়া করা হয়েছে কর্তৃত্বের প্রতি মানুষের আনুগত্যের বিষয়টি যাচাই করার জন্যে। এই পরীক্ষায় দেখা গেছে যাদের ভেতর কর্তৃত্বের ভাব আছে, তারা যখন হুকুম দেয় তাদের অনুগত মানুষেরা মুখ বুজে সেই হুকুম পালন করে ঘোরতর একটা অন্যায় কাজ করে ফেলতে দ্বিধা করে না।
প্রকৃতপক্ষে বিজ্ঞানী স্ট্যানলি। মিলগ্রাম এক্সপেরিমেন্ট করে বিষয়টি প্রমাণ করার চেষ্টা করলেও আমরা কিন্তু দৈনন্দিন জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে এটা অনেকদিন থেকে জানি। 1971 সালে উপরওয়ালার হুকুমে সাধারণ সৈনিক পাখির মতো গুলী করে এই দেশের মানুষকে হত্যা করেছে, কারো মনে এতটুকু অপরাধবোধ জন্মে নি। এই মুহূর্তে বাংলাদেশে র্যাবের সদস্যরা। ক্রসফায়ারের নাম করে একজনকে মেরে ফেলতে দ্বিধা করে না এই একই কারণে–কর্তৃত্বের প্রতি আনুগত্যে!
এটি খুবই বিচিত্র একটি ব্যাপার–আমরা বানরের ভেতরে মানবিক অনুভূতি খুঁজে পাই কিন্তু অনেক মানুষের ভেতর সেটা খুঁজে পাই না!
যাই হোক আমরা শুরু করেছিলাম একটা পশুর অনুভূতি অনুভব করার প্রশ্নটি দিয়ে। সেটি কি কখনো সম্ভব হবে? বিজ্ঞানীরা মনে করেন, সেটি হতে পারে। মানুষের অনুভূতির ব্যাপারটি থাকে মস্তিষ্কে। ইতোমধ্যে মস্তিষ্কের টিস্যু স্থানান্তর করা সম্ভব হয়েছে। একজনের মস্তিষ্কের টিস্যু যদি আরেকজনের মস্তিষ্কে বসানো হয় তাহলে কি সেটি মানুষটির অনুভূতি স্থানান্তরের মতোই একটি ঘটনা নয়? শুধু যে একই প্রজাতির প্রাণীর মস্তিষ্কের টিস্যু স্থানান্তর করা হয়েছে তা নয়, ভিন্ন ভিন্ন। প্রজাতির প্রাণীদের ভেতরেও মস্তিষ্কের টিস্যু স্থানান্তর করা হয়েছে। এটি মাত্র শুরু হয়েছে, আশা করা যায় আগামী পঞ্চাশ বছরে মানুষ সত্যিকার অর্থে বুঝতে পারবে কেমন করে মস্তিষ্ক গড়ে উঠে, কেমন করে সেটা কখনো বুদ্ধিমত্তা, কখনো অনুভূতির জন্ম দেয়।
একজনের অনুভূতি অন্য একজনের অনুভব করার সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা পদ্ধতির সূত্রপাত হয়েছে। মস্তিষ্ক বিজ্ঞানী মিজুয়েল নিকোলেলিস একটা চমকপ্রদ এক্সপেরিমেন্ট করেছেন। একটা বানরের (Owl প্রজাতির) মস্তিষ্কের অসংখ্য নিউরনের ইলেকট্রিক ডিসচার্জ শনাক্ত করে সেটাকে ব্যবহার করে একটা রবোটের হাতকে নাড়ানোর চেষ্টা করেছেন। আপাতঃদৃষ্টিতে মনে হতে পারে এটা বুঝি একটা ছেলেমানুষী খেলনা, মাথার মাঝে কিছু মনিটর লাগানো, সেই মনিটর মস্তিষ্কের ভেতরকার ইলেকট্রিক সিগন্যাল শনাক্ত করে কিছু একটা নাড়াচ্ছে। খেলনা যদি বলতে না চাই–বড় জোর একটা সায়েন্স ফিকশান লেখার আইডিয়া, হাত পা ব্যবহার না করে শুধুমাত্র চিন্তা করে কোনো একটা-কিছু নাড়ানো বা সরানো! কিন্তু আসলে সেটি এই গবেষণায় সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা মাত্রার জন্ম দিয়েছে। আমরা এই পদ্ধতি ব্যবহার করে একটা প্রাণীর মস্তিষ্কের ইলেকট্রিক্যাল সিগন্যালগুলো সংগ্রহ করে একটা বিশাল ডাটাবেস তৈরি করতে পারি। প্রাণীটি যখন ক্ষুধার্ত, যখন শীতার্ত বা যখন ঘুমন্ত, যখন আতঙ্কিত বা ক্রুদ্ধ এ-রকম ভিন্ন ভিন্ন অবস্থার মস্তিষ্কের ইলেকট্রিক্যাল সিগন্যাল যদি জানা থাকে তাহলে সেগুলো দেখেই প্রাণীটির মস্তিষ্কের ভেতরে উঁকি দেয়া সম্ভব। আশা করা যায় আগামী কয়েক দশকে প্রযুক্তির আরো উন্নতি হবে, এই মুহূর্তে যেটা জটিল সেটা সহজ হয়ে আসবে, মানুষ তখন সত্যি সত্যি একটা প্রাণীর মস্তিষ্কের ভেতর উঁকি দিতে শুরু করবে।
একদিন হয়তো আসবে যখন আমরা যদি দেখি রাস্তার মাঝখানে একটি গরু উদাস মুখে দাঁড়িয়ে আছে, আমরা জানতে পারব সে কী ভাবছে! হয়তো অবাক হয়ে আবিষ্কার করব, গরু আসলে ‘গরু’ নয়, সেটি বিশাল একজন দার্শনিক! জগৎসংসার নিয়ে তারও বিশাল একটা চিন্তার জগৎ রয়েছে। কে জানে স্বার্থপর কৌশলী কূটবুদ্ধি অনেক মানুষ থেকে একটা গরুই হয়তো অনেক মহৎ!