এই স্তরে মানুষ এক থেকে দশ মিনিট থাকতে পারে তারপর আবার আগের মতো দ্বিতীয় তৃতীয় স্তর থেকে চতুর্থ স্তর বা গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে পড়ে। প্রতি নব্বই থেকে একশ বিশ মিনিটে মানুষ একবার করে এই পুরো চক্রটির ভেতর দিয়ে যায়। প্রথম দ্রুত চক্ষু সঞ্চালন (REM) স্তর থেকে দ্বিতীয় বারের স্থায়িত্ব আরো বেশি হয় এর পরের স্থায়িত্ব হয় আরো বেশি। ঘুমের এই বিভিন্ন স্তরগুলো 13.6 নং ছবিতে দেখানো হয়েছে।
“দ্রুত চক্ষ সঞ্চালন” (REM) ঘুম মানুষের জন্যে খুব জরুরি। গবেষকরা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করেছেন মানুষ সারা দিন সচেতনভাবে যেটা শিখে ঘুমের এই পর্যায়ে সেটাকে তার মস্তিষ্কে। সঠিকভাবে সাজিয়ে রাখা হয়। অর্থাৎ বিভিন্ন নিউরণের মাঝে সংযোগ তৈরি করে দেয়া হয়। এই সংযোগ করার প্রক্রিয়াটির কারণে মস্তিষ্কে তুমুল কর্মকাণ্ড হতে থাকে তাই মস্তিষ্কের তরঙ্গ দেখলে মনে হয় মস্তিষ্কটি বুঝি পুরোপুরি সচেতন কিন্তু প্রকৃত অর্থে মানুষটি ঘুমিয়ে আছে। একজন মানুষের পুরো জীবনটিই হচ্ছে নূতন নূতন যায় যেটা জেগে থাকার মতোই, মস্তিষ্কে তখন তুমুল কর্মকাণ্ড হতে থাকে। বিষয় জানা, শেখা স্মৃতিতে। ধরে রাখা যেন পরবর্তীতে সেটা ব্যবহার করতে পারে। মস্তিষ্কের মাঝে পাকাপাকিভাবে সংরক্ষণে এই কাজটি করা হতো “দ্রুত চক্ষু সঞ্চালন” (REM) স্তরে। এই স্তরটিতে না গেলে আমরা কখনোই আমাদের স্মৃতিটিকেই গড়ে তুলতে পারতাম না।
পরীক্ষার আগে অনেক ছাত্র-ছাত্রী প্রায় সারারাত পড়াশোনা করে পরীক্ষা দিতে যায়। তারা নিজের অজান্তেই নিজেদের অনেক বড় ক্ষতি করে বসে থাকে, সারারাত জেগে তারা যেটি পড়ে সেই বিষয়টা তাদের মস্তিষ্কে নাড়া চাড়া করে। কিন্তু না ঘুমানোর কারণে তারা মস্তিষ্কে সেটা পাকাপাকিভাবে বসাতে পারে না। তাই পরীক্ষার হলে যখন সেই তথ্যের প্রয়োজন হয় তারা আবিষ্কার করে সেটি তাদের মস্তিষ্কে নেই।
.
14. প্রাণীদের ভাবনার জগৎ
আমরা যখন কোনো চমৎকার প্রাকৃতিক দৃশ্যের মুখোমুখি হই তখন প্রায় সময়েই আমাদের মাথায় একটা প্রশ্ন খেলা করে সেটি হচ্ছে আমি যেটা যেভাবে দেখছি অন্যেরাও কি সেটা সেভাবে দেখছে? আমি যেটাকে সবুজ বলি অন্য একজনের কাছে কি সেটা আমার দেখা সবুজ নাকি অন্য কোনো রং! আমি যেটাকে লাল বলছি অন্যেরাও সেটাকে লাল বলছে কিন্তু তারা কী লাল রংটা ঠিক আমার মতো করেই দেখছে নাকি অন্য কোনোভাবে দেখছে? (আমরা জানি যারা কালার ব্লাইন্ড তারা কিছু-কিছু রং দেখতে পারেন না কিন্তু সেটা অন্য ব্যাপার) ঠিক এইভাবে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমরা যখন হঠাৎ করে দেখি রাস্তার ঠিক মাঝখানে একটি গরু উদাসভাবে তাকিয়ে আছে তখন কি আমাদের ভেতরে এক ধরনের কৌতূহল হয় না যে এই গরুটা এখন কী ভাবছে? নিশ্চিতভাবেই তাদের চিন্তার প্রক্রিয়াটি অনেক ভিন্ন কিন্তু কতটুকু ভিন্ন? তাদের ভেতরে কী ধরনের চিন্তা খেলা করে? তাদের ভেতরে কি মানবিক অনুভূতি আছে?
একদিন হঠাৎ পথের ধারে একটা পাখির ছানা আবিষ্কার করেছিলাম, সে তারা বাসা থেকে পড়ে গেছে। পাখির ছানার কাছেই তার মা, বাচ্চাটিকে রক্ষা করার জন্যে তার মায়ের যে আকুতি সেটা দেখে আমি নিঃসেন্দেহ হয়েছিলাম পাখিদের মাতৃস্নেহ আছে, কিন্তু সেই স্নেহটা কেমন? কতটুকু গভীর? আমরা কি সেটা কোনোদিন অনুভব করতে পারব?
বিজ্ঞানীরা ব্যাপারটা নিয়ে গবেষণা করছেন। পশুদের মানবিক অনুভূতি নিয়ে ষাটের দশকে একটা খুব বিখ্যাত এক্সপেরিমেন্ট করা হয়েছিল। এক্সপেরিমেন্টটা এ-রকম : একটা বানরকে (rhesus প্রজাতির বানর) প্রথমে শেখানো হলো যে একটা লিভার টানলে তার খাবারটুকু চলে আসে। বানরকে এটা শেখানো এমন কিছু কঠিন নয়–আমরা পথেঘাটে বানরের খেলা দেখি সেখানে বানর শ্বশুরবাড়িতে নববধূ কেমন আচরণ করে এ-রকম কঠিন বিষয় পর্যন্ত অনুকরণ করে দেখিয়ে ফেলে! যাই হোক বানরকে লিভার টেনে তার প্রাত্যহিক খাবার আনার ব্যবস্থাটা শিখিয়ে দেবার পর বিজ্ঞানীরা একটা খুব বিচিত্র কাজ করলেন, এই বানরের খাঁচার পাশেই আরেকটা খাঁচায় ভিন্ন একটা বানর রাখলেন। এখন তারা লিভারের সাথে এমনভাবে কিছু বৈদ্যুতিক যোগাযোগ করিয়ে দিলেন যে, এখন লিভারটি টানা হলে শুধু যে খাবার আসে তা নয়, তার সাথে সাথে একটা ভয়ানক ব্যাপার ঘটে। পাশের খাঁচায় যে বানরটা রাখা হয়েছে সেট বানরটি তখন একটা ভয়ংকর ইলেকট্রিক শক খায় বলা বাহুল্য ইলেকট্রিক শক কোনো আরামদায়ক অনুভূতি নয় কাজেই বানরটি যন্ত্রণায় চিৎকার করে লাফঝাঁপ দিয়ে তার কষ্ট এবং আতঙ্কটুকু খুব ভালোভাবে প্রকাশ করে দেয়। এখন বিজ্ঞানীরা একটা অত্যন্ত চমকপ্রদ বিষয় আবিষ্কার করলেন। প্রথম বানরটি যখন দেখল তার লিভার টানার কারণে তার খাওয়া আসা বন্ধ হয়ে গেছে, বেচারা বানর দিনের পর দিন অভুক্ত থাকা শুরু করল তবুও লিভার টেনে অন্য বানরকে কষ্ট দিল না। বিজ্ঞানীরা পরীক্ষাটি নানাভাবে করে মোটামুটি নিশ্চিত হলেন যে বানরের ভেতর চমৎকার একটা “মানবিক” অনুভূতি আছে। এই অনুভূতিটি অনেক বেশি স্পষ্ট হয় যদি সেই বানর নিজে অতীতে ইলেকট্রিক শক খেয়ে তার যন্ত্রণাটা অনুভব করে থাকে। পরিচিত এবং স্বজাতির জন্যে তাদের অনুভূতি বেশি থাকে, অপরিচিত কিংবা ভিন্ন প্রজাতির পশু হলে তাদের অনুভূতি কমে আসতে থাকে। বলা যেতে পারে বিজ্ঞানীরা নানাভাবে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে মোটামুটি নিশ্চিত হয়েছেন, আমরা সেটাকে সমবেদনা বা মানবিক অনুভূতি বলি বানরের ভেতর সেটা বেশ ভালো পরিমাণেই আছে।