আশ্চর্যজনকভাবে মানুষ জন্মের পর থেকেই। নিয়মিতভাবে ঘুমাচ্ছে কিন্তু ঘুম বিষয়টা কী। সেটা নিয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞান মাথা ঘামাতে শুরু করেছে তুলনামূলকভালো অনেক পরে। 1931 সালে হ্যাঁন্স বার্গার নামে একজন জার্মান। মনোবিজ্ঞানী প্রথমবার মানুষের মাথায় ইলেকট্রড লাগিয়ে মানুষের মস্তিষ্কের বৈদ্যুতিক সিগনাল মাপার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি দেখলেন মানুষ জেগে থাকলে তার মস্তিষ্কের বৈদ্যুতিক সিগনালগুলো (EEG) হয় দ্রুত কম্পনশীল। যখন সে ঘুমিয়ে যায় তখন কম্পন কমে আসে কিন্তু সিগন্যালগুলো হয় বড়। সোজা কথায় বলা যেতে পারে একজন মানুষ ঘুমিয়ে আছে নাকী ঘুমের ভান করে ঘাপটি মেরে পড়ে আছে সেটা তার মস্তিষ্কের ইলেকট্রিক সিগন্যালটা দেখেই বুঝে ফেলা যাবে!
1935 সালে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির গবেষকরা দেখলেন ঘুমের বিভিন্ন স্তর রয়েছে এবং ঘুমের বিভিন্ন স্তরে (প্রাথমিক থেকে গভীর ঘুম) মানুষের মস্তিষ্কের (EEG) বৈদ্যুতিক সিগনালগুলোরও সুনির্দিষ্ট পরিবর্তন হয়। মানুষ যেহেতু শোয়ার ঘণ্টাখানেকের ভেতরেই গভীর ঘুমে ঢলে পড়ে তাই গবেষকরা প্রথম ঘণ্টা দুয়েকের তথ্য নিয়েই সুন্তষ্ট ছিলেন। গভীর ঘুমে অচেতন হওয়ার পরেও যে মানুষের মস্তিষ্কে অত্যন্ত চমকপ্রদ কিছু ব্যাপার ঘটতে থাকে তারা সেটা কখনো জানতে পারেন নি। সেই ব্যাপারটা প্রথম চোখে পড়েছে। প্রায় দুই দশক পরে, ইউজিন আজেরিনস্কী নামে ইউনিভার্সিটি অফ শিকাগো এর “ঘুম ল্যাবরেটরির” একজন ছাত্র-গবেষকের চোখে। তার চোখে প্রথম ধরা পড়েছে যে গভীর ঘুমের পর মানুষের ঘুম আবার হালকা হয়ে যায় তখন হঠাৎ করে ঘুমের মাঝে তাদের চোখ নড়তে শুরু করে, মস্তিষ্কের বৈদ্যুতিক সিগনাল দ্রুততর হয়ে উঠে। ঘুমের এই স্তরে চোখ দ্রুত নড়তে থাকে বলে এটাকে বলা হয় ‘দ্রুত চোখ সঞ্চালন স্তর’ (Rapid Eye Movement) সংক্ষেপে REM। এ-রকম সময়ে যদি ঘুমন্ত মানুষকে ডেকে তোলা হয় তাহলে তারা প্রায় সব সময়েই বলে থাকে যে তারা কিছু একটা স্বপ্ন দেখছিল। ইউনিভার্সিটি অফ শিকাগো এর গবেষকরা ঘুমের উপর এই নতুন স্তর আবিষ্কার করার পর পৃথিবীর অন্যান্য গবেষকরা গবেষণা করে আবিষ্কার করলেন, ঘুম বললেই আমাদের মস্তিষ্ক পুরাপুরি অচেতন হয়ে যাচ্ছে বলে যে রকম ধারণা হয় সেটা একেবারেই সত্যি নয়। ঘুমের মাঝে আমাদের মস্তিষ্কে হঠাৎ হঠাৎ পুরাপুরি কাজ করতে শুরু করে, শুধু মস্তিষ্ক নয় সাথে সাথে আমাদের শরীরও প্রায় সচেতন হয়ে উঠে। ঘুম হঠাৎ করে আমাদের সচেতন জীবনের কর্মদক্ষতার সাথে গভীরভাবে যুক্ত হয়ে উঠে।
13.5 নং ছবিতে মানুষের ঘুমের বিভিন্ন স্তরে তার মস্তিষ্কের বৈদ্যুতিক সিগনালগুলো (EEG) দেখানো হয়েছে। বিছানায় শোয়ার পর যখন একটু তন্দ্রামতো এসেছে, এখনো ঘুম আসে নি বলে জাগ্রত অবস্থা তবে শরীর শিথিল হয়ে এসেছে তখন মস্তিষ্কের বৈদ্যুতিক সিগনালের কম্পন থাকে সেকেন্ডে আট থেকে বারো, এটাকে বলে আলফা তরঙ্গ। আলফা স্ত রে কয়েক মিনিট থাকার পর মানুষ ধীরে ধীরে নিশ্বাস নিতে শুরু করে, মস্তিষ্কের বৈদ্যুতিক সিগনালের কম্পনও কমে সেকেন্ডে চার থেকে আটে নেমে আসে। এই স্তরটির নাম থিটা স্তর বা ঘুমের প্রথম স্তর। এই স্তরে মানুষ দশ সেকেন্ড থেকে দশ মিনিটের মতো থাকতে পারে। ঘুমের প্রথম স্তরে থাকা কাউকে ডেকে তুললে সে সাধারণত চট করে জেগে উঠতে পারে। তার চারপাশের অবস্থা সম্পর্কে তখনো সে মোটামুটি সজাগ থাকে।
থিটা স্তর বা ঘুমের প্রথম স্তর থেকে মানুষ ঘুমের দ্বিতীয় স্তরে প্রবেশ করে, এখানে দশ থেকে বিশ মিনিটের মতো থাকতে পারে এবং এটাকে বলা যায় মানুষের সত্যিকার ঘুমের শুরু। এই স্তরে পৌঁছানোর পর মানুষ তার চারপাশের অবস্থার কথা পুরাপুরি ভুলে যায়।
ঘুমের দ্বিতীয় স্তর থেকে মানুষ তৃতীয় স্তরে প্রবেশ করে। তখন থিটা তরঙ্গের সাথে খুব ধীরে ধীরে লয়ের ডেলটা তরঙ্গ এসে হাজির হতে থাকে। কিছুক্ষণের ভেতরে থিটা তরঙ্গ পুরাপুরি অদৃশ্য হয়ে যায় এবং তার বদলে ধীরে লয়ের বড় বড় ডেলটা তরঙ্গ এসে হাজির হয়। এটাকে বলা হয় ঘুমের চতুর্থ স্তর বা গভীর ঘুম। ঘুমের চতুর্থ স্তর থেকে কাউকে জাগিয়ে তুললে চারপাশে কী হচ্ছে সে বুঝতে পারে না, ছোট বাচ্চারা এ-রকম অবস্থায় পৌঁছে গেলে তাদের কিছুতেই জাগিয়ে তোলা যায় না। মানুষ যখন গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে পড়ে তখন তাদের রক্তচাপ তাপমাত্রা, হৃৎস্পন্দন এবং নিশ্বাসের গভীরতা কমে আসে। মস্তি ষ্কে রক্তের প্রয়োজন হয় সবচেয়ে কম এবং সারা শরীর পুরাপুরি শিথিল হয়ে আসে। মানুষের গ্রোথ হরমোন তখন সবচেয়ে বেশি শরীরে ছড়িয়ে পড়ে, এইজন্যে শিশু কিশোরের শরীর গড়ে তোলার জন্যে চতুর্থ স্তর বা ডেলটা স্তরের ঘুমের খুব প্রয়োজন।
ত্রিশ থেকে চল্লিশ মিনিটের গভীর ঘুমের পর মানুষ আবার আগের স্তরে ফিরে যেতে শুরু
করে। চতুর্থ স্তর থেকে তৃতীয়, তৃতীয় থেকে দ্বিতীয় কিন্তু দ্বিতীয় থেকে ঘুম এবং জাগরণের মাঝামাঝি প্রথম স্তরে না গিয়ে “দ্রুত চোখ সঞ্চালন” (Rapid Eye Movement বা REM) স্তরে চলে আসে। মস্তিষ্কে রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি পায়, হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়, নিশ্বাস দ্রুততর হয়ে উঠে, রক্তচাপ বেড়ে যায়। মানুষ জেগে থাকলে যা হওয়ার কথা প্রায় সেরকমই হয় কিন্তু মানুষটা তখন ঘুমিয়েই থাকে এবং সাধারণত রাতের প্রথম স্বপ্নটি তখন দেখে।